Sunday, June 21, 2009

মন্ত্রীদের সত্য কথা বলতেই হবে

মন্ত্রীর মূল ধাতু ‘মন্ত্র’ শব্দটি সংস্কৃত থেকে বাংলায় এসে ঢুকে পড়েছে। অর্থ হল বিচক্ষণ মানুষদের কথাবার্তা। পনেরোশ’ খৃষ্টপূর্বাব্দ বেদীয় যুগ থেকে এই শব্দটির চালু রয়েছে বলে বাংলাপিডিয়া লিখেছে। ভক্ত-অনুরক্তদের স্বর্গীয় ভাবাবেগে মত্ত করার জন্য তান্ত্রিক হিন্দু ও বৌদ্ধ উপাসনালয়ে নানা ধরনের ‘মন্ত্র’ উচচারিত হয়। ‘মন্ত্র’ দেয়ার শব্দসমূহ অতি পবিত্র বলে গণ্য, প্রাঞ্জল্য ভাষায় পংক্তিবদ্ধ এবং অতি পাওয়ারফুলও বটে। এতে মন প্রশান্তিতে ভরে যায়, কথার যাদু মালায় সর্বত্র‌ই যেন শান্তির ধারা পরিলক্ষিত হয়। তান্রিক ধর্ম মতে, ‘মন্ত্র’ দিতে গেলে অবশ্যই একজন গুরু লাগে, অর্থাৎ প্রধান মন্ত্রনাদানকারীকে ধরতে হয়। ধর্মাচারকে স্বতঃসিদ্ধ করতে একই মন্ত্রসমূহ সুন্দর, সাবলীল ভাষায় বারবার বলা চাই। যদিও চতুর্থ শতাব্দীর বেদিক পূরোহিত কাতসা এবং বৌদ্ধ দার্শনিকপান্ডব বাসুবন্ধু বলেছেন, ‘মন্ত্র ফন্ত্র হলো একদম বোগাস। ওসবে কোন কাজ হয়না।’
কাজ হোক বা না হোক ‘মন্ত্র’ শব্দের সাথে স্বর্গ ও আধ্যাত্মিকতার ভাব আছে বলে পশ্চিমেও পাদ্রীদেরকে ‘মিনিস্টার’ নামে ডাকা হয়। যেমন, অমুক হলেন ‘মিনিস্টার অব চার্চ হলিক্রস’ অর্থাৎ তিনি হলেন হলিক্রস চার্চের পাদ্রী ।

পানি-পড়া, মন্ত্র-পড়া, ওঝা বা গনকদের কাজ-কর্ম্মের প্রভাব খুব বেশী মানুষদের উপর পড়ে না। এক ব্যক্তি থেকে বড়জোর একটি পরিবার। কিন্তু দেশ চালানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ বা মন্ত্রী-মিনিস্টাররা বোগাস কথা বললে পুরো জাতি প্রভাবিত হয়, প্রতারিত হয়। এমনকি বিভ্রান্তিতে পতিত হওয়ার রেকর্ডও আছে। যেমন, বুশ তার দেশের গোয়েন্দা প্রধানের দেওয়া মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে ইরাক আক্রমণ করেছিলেন।
সারা দুনিয়ার শাসককূলই কম-বেশী এই মিথ্যা কথা বলার কাজটি সচেতনভাবেই করে থাকেন। অন্যভাবে বললে তারা ‘অধিক মিথ্যা’ কিংবা ‘কম সত্য’ কথা বলেন। ডঃ আসকার ইবন শাইখ ১৯ মে মৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগে এনটিভি’র একটি টকশো’ তে উপস্থিত হয়েছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল বর্তমানে কোন্‌ জিনিস তাঁকে সবচেয়ে ব্যথিত করে। তিনি এক বিন্দু চিন্তা না করে বলেছিলেন, ‘মিথ্যা ভাষণ। সর্বত্রই এখন মিথ্যা। উপর থেকে নীচ পর্যন্ত সবাই মিথ্যা কথা অবলীলায় বলে যায়’।
বাংলাদেশে এর চর্চা উপরদিক থেকে ইদানিং মারাত্মক আকারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ডিজিটাল জেনারেশন ধরে নিয়েছিল জড়াগ্রস্থ পুরোনো ব্যর্থ দিনগুলোকে পায়ে মাড়িয়ে নতুনরা দেশের দিনসব একদম বদল করেই ছাড়বে। কিন্তু বিধি বাম! লংকায় গেলে নাকি সবাই রাবণ হয়! আমাদের রাবনেরা এমন ভাবে মাথা ঝাকিয়ে, গা দুলিয়ে মিথ্যা কথা বলেন, ভাবেন হনুমানেরা বুঝি কিচ্ছু বোঝেনা! কত রাবনের প্রস্থান যে হনুমানদের ইতিহাসে ভরা সেসব নতুন করে বর্তমান রাবনদের বোঝাবে কে?
ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’ বাংলাদেশের সাথে অনেক দেশকেই কিছুটা হলেও ‘আউলা’ করে দিয়ে গেছে। স্বাধীনতার অন্যতম এক মহানায়কের গর্বিত সন্তান ও চৌকষ একজন মন্ত্রী যখন চারদিন ‘সর্দি’ বা ‘হাইবারনেশন’ শেষ করে স্বপ্রণোদিত হয়ে মিডিয়াতে বললেন, ‘কিসের পদত্যাগ? আমরা দিন বদলের জন্য কাজ করছি। পরিবর্তন আনতে চাইলে নিজেদের পরিবর্তিত করতে হবে। ত্যাগের মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে। কাজ করতে গেলে বাধা তো আসবেই সেগুলো ভেঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে (আমারদেশ, জুন৪, ২০০৯),’; ঠিক তখনি কানাডার পার্লামেন্টে তুমুল হট্টগোল বেধে গেল। হাউজ অব কমন্সে কানাডার ন্যাচারাল রিসোর্স মিনিস্টার লিসা রেইটের পদত্যাগের দাবী করল সবগুলো বিরোধী দল মিলে। লিসার স্বহস্তে লেখা ‘সিক্রেট’ সরকারী ডকুমেন্ট সিটিভি’র অটোয়া নিউজরুমে পড়েছিল। ৩ জুন লিসা হাউসে বিরোধী পার্লামেন্টেরিয়ানদের দাবীর মুখে বললেন, ‘অবশ্যই সঠিক পদ্ধতি না মানায় এই কান্ডটি ঘটেছে। পদত্যাগপত্র আমি আগেই জমা দিয়েছিলাম, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তা গ্রহন করেননি।’ প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার বিরোধী দলের তুমুল ‘হো’,‘হো’ ধবনির মধ্যে বললেন, ‘এটা লিসার ভুল নয়। তিনি ওই সময় সরকারী কাজেই অন্যত্র ছিলেন। তাঁর একজন স্টাফের অসতর্কতায় এমনটি হয়েছে। এর জন্য লিসাকে দায়ী করা সমীচিন নয়।’ এরপর আবারো মেডিক্যাল আইসোটোপ নিয়ে সহকারীর সাথে লিসার অসংলগ্ন কথাবার্তার টেপ জনসম্মুখে প্রকাশ হয়ে পড়ায় হারপার প্রশাসনও লজ্জা পেয়েছেন। লিসা সজল নয়নে দুঃখ প্রকাশ করেছেন পার্লামেন্টে সবার সামনে। ইতোমধ্যে রিসোর্স মিনিস্টার অফিসের কমিউনিকেশন বিভাগের ডিরেক্টর জ্যাসমীন ম্যাকডোনেল সব দায়-দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করে পদত্যাগের ঘোষনা দিয়ে ইস্যুটি থেকে নিজেকে সযত্নে প্রত্যাহার করে নিলেন।
আর ওদিকে ব্রিটেনের ইতিহাসে প্রথমবারের মত স্পীকারের পদত্যাগের পর সরকারে যেন শনির দশা লেগেই আছে। এক সপ্তাহের মধ্যেই চারজন ফুল মন্ত্রী এবং দু’জন জুনিয়র মন্ত্রী ‘ব্যক্তিগত’ কারন দেখিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। ওয়ার্ক এন্ড পেনশন বিষয়ক মন্ত্রী জেমস পার্নেল পদত্যাগপত্রটি পাঠানোর সময় সাহস করে প্রধানমন্ত্রী ব্রাউনকেও পদত্যাগের আহ্বান জানিয়ে সাথে একটি চিঠি জুড়ে দিয়েছেন। ব্রাউনের ‘শ্যাম না কূল রাখি’ অবস্থা! চিঠিতে পার্নেল লেখেন, ‘আমি মনে করি আপনার প্রধানমন্ত্রীর চেয়ার ধরে রাখা মানেই বিরোধী দলকে আগামী নির্বাচনে জয়লাভের সুযোগ করে দেয়া। ........ আমি আপনাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি, আপনি প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করুন এই যেমন আমি সরকার থেকে পদত্যাগ করছি।’ প্রধানমন্ত্রী এসব কথাকে উড়িয়ে দিয়েছেন। তাইতো দিবেন, শাসনে থাকলে সবাই এমন পরিচিত প্রতিক্রিয়াই প্রথমে দেখান।
যাহোক, সাধারন মানুষদের মত মন্ত্রীরাও বিপদে পড়ে গেলে মিথ্যা কথা বলেন। শুধু তাই নয়, পদ থেকে ইস্তফা দেয়ার সময়ও শেষবারের মত ‘ব্যক্তিগত’, ‘পারিবারিক’, ‘স্ত্রী-সন্তানকে সময়দান’, ‘সর্দিজ্বর’ ইত্যাদি জাতীয় কথাবার্তা বলে নিশ্চিত প্রস্থান চান। কৌশলজনক কথা বলে এড়িয়ে যাওয়া আর ডাহা বোকা মার্কা মিথ্যা কথা বলা এক নয়। ‘রাষ্ট্রের প্রয়োজনে’ এসব মিথ্যা ও বাড়তি কথা বলার পরিণতি অনেক সময়ই যে মারাত্মক তা এক-এগারো বাংলাদেশে খানিকটা হলেও বুঝিয়ে দিয়েছে। ভেবেছিলাম, ‘লুকিং ফর শত্রুজ’ মার্কা মন্ত্রীদের কবল থেকে দিন বদলের মন্ত্রীসভা রক্ষা পাবে। কিন্তু এ দেখছি বাঘের আক্রমন থেকে বাঁচতে গিয়ে সিংহের থাবায় পড়ে জাতি এখন ‘শকিং ফর দিন বদলের মন্ত্রীজ’!
‘মন্ত্রী’ শব্দটির সাথে পূত-পবিত্রের অমীয় ধর্মীয় গন্ধযুক্ত থাকলেও এখন তাতে মারাত্মক পচন ধরেছে। মিডিয়াতে এমনভাবে ইনারা মিথ্যা কথা বলেন যেন জনগন কিচ্ছু বোঝেনা! কিন্তু জনগন যে শুধু বোঝেন তাই ই নয়, মন্ত্রীরা মগজে কি চিন্তা লালন করেন সেটিও যে বলে দিতে পারেন, তা উনারা ঠাহর করতে পারেন না। সকল সরকারের দুই একজন ছাড়া সব মন্ত্রীই উচ্চশিক্ষিত হন। বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা প্রাপ্ত হন, আবার লেখাপড়া শেষ করে বিদেশীনিকে নিয়ে ঘর করছেন এমনজনকেও ধরে এনে মন্ত্রী বানানোর রেকর্ড আছে। কিন্তু বাংলাদেশের ভাইরাস এতই শক্তিশালী, বাইরের কোন ভাল অভ্যাসই এখানে কাজ করেনা। জিয়াতে নামলেই পূর্বের বদ অভ্যাসসমূহ মূহুর্তেই শরীরে এসে ভর করে। শুরু হয়ে যায় ঠিক পূর্বের স্থানে রেখে যাওয়া নোংরা বক্ররেখা থেকেই নতুন যাত্রা!

পাঠক, এবার আসুন আমাদের ‘চমক মন্ত্রীসভার’ চমকানো কথাসমুদ্র থেকে প্রতিদিনকার খন্ডিত কিছু কথা তুলে আনি।
গুরু মন্ত্রী সংসদে বললেন, ‘আগের আমলে অত হাজার কোটি টাকা শুধু বিদ্যুতের খাম্বা বাবদই লাপাত্তা হয়ে গেছে।’ পূর্ব্বতন মন্ত্রী বলেন, ‘তত কোটি টাকা তো পুরো বিদ্যুত মন্ত্রণালয়ের বাজেটেই ছিল না।’ আরেকজন মন্ত্রী সবদিক থেকেই এগিয়ে আছেন। ব্যবসায়ীদের বার্ষিক মিটিং-এ গিয়ে দেশে ব্যবসা-বানিজ্য ও কর্মবৃদ্ধির কথা বললেই ভাল শোনায়। তা না বলে বলেন, ‘জঙ্গি ও স্বাধীনতাবিরোধীরাই সেনা অফিসারদের মেরেছে (ইত্তেফাক, মার্চ ৭)। তাদের ইন্টারন্যাশনাল কানেকশন খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’ সরকারী তদন্ত কমিটি বল্ল, ‘না ওরা তো মারেনি (মার্চ২১, আমাদের সময়)।’ সাংবাদিকরা মন্ত্রীকে ধরে জিজ্ঞেস করল, দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হয়ে আপনি এ কথা বললেন কেন? মন্ত্রী বললেন, ‘আমার মনে হয়েছে তাই বলেছি (প্রথম আলো, আমারদেশ ২৪ মার্চ)।’তদন্ত কমিটির পুরো প্রতিবেদনটি জনসমক্ষে প্রকাশ না করার কারণ ব্যাখ্যা করে মন্ত্রী বললেন, ‘প্রতিটি দেশেই তদন্ত প্রতিবেদনে তিনটি বিষয় থাকে। এগুলো হচ্ছে ‘সিক্রেট (গোপনীয়), টপ সিক্রেট (অতি গোপনীয়) এবং ওপেন (প্রকাশযোগ্য)। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই গোপন জিনিস প্রকাশ করা হয় না। এ ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে। আগামীতে পুরো তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করার সম্ভাবনা নেই (নয়াদিগন্ত, মে২৯)।’ আরেক বড় মন্ত্রী মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের একই বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে বললেন, ‘যা প্রকাশ হয়েছে তাই ই পূর্নাঙ্গ। পূর্নাংগ প্রতিবেদনই জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়েছে (নয়াদিগন্ত, মে ২৯)।’
কুয়ালামপুর ৫৫ হাজার বাংলাদেশী ভিসা বাতিলের ঘটনায় মন্ত্রী বললেন, ‘এতে বংগবন্ধুর খুনী ও যুদ্ধাপরাধীদের হাত থাকতে পারে (আমারদেশ, মার্চ১৮)।’ ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র মহসিন শেখ ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাকে ক্রসফায়ারে হত্যা করার খবর সব পত্রিকা প্রকাশ করে স্বজনদের বরাত দিয়ে লিখল, ‘তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কোনো অভিযোগ নেই। কোনো থানায় একটি মামলা বা ডিও নেই। কেউ কখনো তাদের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের কাছেও অভিযোগ করেননি।সহপাঠী ও বন্ধুবান্ধবদের কাছেও তারা ছিল খুবই প্রিয়। (আমারদেশ, মে৩০)।’ দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী বললেন, ‘আমরা জনগণের সরকার। জনগণের সেবা করার জন্য ক্ষমতা নিয়েছি। প্রতিটি বিষয়ে আমরা সজাগ রয়েছি। আমরা সব সময় বিচারবহির্ভুত হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে। এ সরকারের আমলে বিচারবহির্ভুত হত্যার কোন ঘটনা ঘটেনি (যুগান্তর, আমারদেশ, মে৩১)।’ ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল ও কৃমিনাশক ট্যাবলেট খেয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে দেড় হাজারের বেশি শিশু অসুস্থ হয়ে পড়ার খবর প্রতিটি পেপার ও চ্যানেলের মাধ্যমে সারা দেশে খবর ছড়িয়ে গেল (যুগান্তর, জুন ৮; মানবজমিন, জুন ৯)। মন্ত্রী মহোদয় বিশ্বস্বাস্থ্যের দেয়া ঔষধগুলো রি-চেক, সঠিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয়েছে কিনা জানার প্রয়োজন বোধ না করে বললেন, ‘এসবই অপপ্রচার, যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, যারা শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে ২১ আগস্ট বোমা হামলা চালিয়েছে, যারা দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়, তারাই এ কাজ করছে (আমারদেশ, নয়াদিগন্ত, জুন৯)।’ সৌদী সফর থেকে ফিরে এসে আগের রেকর্ড না চেক করেই মন্ত্রী উক্তি, ‘বিগত সাত বছরে সৌদির বাদশাহ্‌র সাথে বাংলাদেশের কোনো প্রধানমন্ত্রীর এটাই প্রথম বৈঠক (জুন ৮, নয়াদিগন্ত)।’ মন্ত্রী বাংলাদেশ ও ভারতের মণিপুরের পানি বিশেজ্ঞদের অবাক করে দিয়ে পিনাকীয় সুরে বললেন, ‘টিপাইমুখে বাধ দিয়ে ভারত পানি বিদ্যুত তৈরী করলে বাংলাদেশের কোন ক্ষতি হবে না (আমাদের সময়, ২০ মে),’ এবং ‘খুশী হয়ে ভারত যতটুকু পানি তাই ই আমাদের লাভ (নয়াদিগন্ত ৮ জুন)।’
এসব আমাদের মন্ত্রীদের কথা, এরকম হাজারো উদ্ধৃতি দেয়া যায়। পাঠকদের ধৈর্য্যচুতি ঘটবে। আর হ্যাঁ, এসব উক্তির জন্য তো বিরোধীদলকেও দায়ী করা যাবেনা।
এমন মন্ত্রীদের দিয়েই আমরা ডিজিটাল বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখব, ভিশন ২০২১ বাস্তবায়নে এগিয়ে যাব, মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে শিখব। আশা করতে পারিনা?
সুন্দর করে কথা বলা একটা আর্ট। ‘সত্য কথা বলা’ কিংবা ‘কথা-বার্তার চেয়ে কাজ বেশী করা’ মন্ত্রীদের শিখতে হবে। সাংবাদিকদের মাইক দেখলেই দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হওয়া যাবে না। উন্নতদেশে মন্ত্রীরা মিডিয়া থেকে পালিয়ে বেড়ান, আর আমাদের দেশে মন্ত্রীরা অফিস থেকে বেড়িয়েই আট-দশটি মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে যান।
পাচঁ মাস খুব বেশীদিন নয়, এতে দিন বদল হয় না। তাই বলছিলাম, বাকী সাড়ে চার বছরে আমাদের মন্ত্রী-মহোদয়বর্গ ‘সত্য ও কঠিন কথা’ সোজা করে বলা শিখে যাবেন। আগের মন্ত্রীরা দেশটাকে বাজে অবস্থায় নিয়ে গেলেও আশা করবো দিন বদলের ‘ফ্রেশ’ মন্ত্রীরা এবার তা আর করবেন না। আরেকটা কথা না বললেই নয়, ইন্দিরা গান্ধীকে ভারতীয় সৈন্য ফেরত নেবার ‘কঠিন সত্য কথাটি’ কিন্তু সহজভাবে বলার রেকর্ড বাংলাদেশের রয়েছে। বাংলাদেশ কোন হেলাফেলাদের দেশ নয়। গর্ব করার মত অনেক কিছুই আমাদের রয়েছে। নোংরা ও অদূরদর্শী রাজনীতিবিদরা দেশটাকে এগিয়ে নিতে বাধা সৃষ্টি করলেও এদেশের মেধাবীরা বিশ্বে সৃজনশীল ইতিহাস সৃষ্টি করতে সাহায্য করছে। গ্লোবাল ভিলেজের যুগে মহারথীদের ভয়ে ভীত হবার কিছু নেই, মানে ইন্ডিয়ার নামটা আসলেই জিহবাটা যেন আড়ষ্ট না হয়ে যায়। জর্জিয়াতে রাশিয়া পারেনি, একক পরাশক্তি আমেরিকার প্রতিবেশী হয়ে ছোট্ট রাষ্ট্র কিউবা বুক ফুলিয়ে টিকে আছে, মহাশক্তিধর বুশ হা হয়ে ছিলেন যখন ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট মুখের উপর তাকে ‘শয়তান’ বলছিলেন। এসবের জন্য ছোট রাষ্ট্রদের যুদ্ধে যেতে হয়নি। আমরা অতি বিপ্লবী হতে চাইনা, দরকারও নেই। শুধু চাই আমাদের সোজা-সাপটা সত্য কথাটা মন্ত্রীরা জোরের সাথে বলুক, বিশ্ববাসী জানুক। মনে রাখতে হবে, ‘শয়তান’ যত বড় শক্তিশালীই হোক না কেন তার ষড়যন্ত্র বড়ই দূর্বল (আল-কোরআনঃ ৪:৭৬)। বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীও কিন্তু বারে বারে এর প্রমাণ দেখিয়েছে।
অস্টম শতাব্দীর জার্মান দার্শনিক কান্ট বলেছিলেন, ‘ফিয়াত জাস্টিফিয়া, পেরিট মুন্ডুস (ইনসাফ নিশ্চিত কর, যদিও পৃথিবী একদিন ধবংস হয়ে যাবে)।’ কথাটাকে ঘুরিয়ে তিনি অন্যভাবে এরকমও বলেছেন, ‘ন্যায়-বিচারকে সমুন্নত রাখো এমনকি পৃথিবীর সব ‘বান্দর’দেরকে এর মাধ্যমে শাস্তি দিয়ে হলেও।’

Thursday, June 4, 2009

তামিল রাষ্ট্র গঠন স্বপ্নই থেকে গেল


প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাক্সে খুশীতে গোটা শ্রীলংকা একদিন বন্ধ ঘোষণা করে আতশবাজি ফুটিয়ে বিজয় দিবস পালন করলেন। তামিল বাদে সিংহলীসহ সব সম্প্রদায়ের মানুষজন রাস্তায় নেমে একাকার উৎসবে মেতে উঠেছে। কি রাষ্ট্রপ্রধান, সেনাপ্রধান সবাই জনতার সাথে মিশে ডেকচি ভর্তি খাবার থেকে একে অপরের গালে তুলে দিয়ে জয় প্রকাশ করে খাচ্ছে। মাত্র দু’মাস আগেও এরকম দৃশ্য ছিল অকল্পনীয়। আর অন্যদিকে সারা বিশ্বের তামিলরা কাঁদছে। আইরিশরা এমনটি কেঁদেছিল আইরিশ গেরিলাদের পরাজয়ের পর। ১৭ মে ২০০৯ তারিখে স্বাধীন ভূমি প্রতিষ্ঠার আরো একটি স্বপ্নের করুণ মৃত্যু হয়ে গেল। সাথে থেকে গেল লক্ষ লক্ষ স্বজন হারানোর কত দূঃসহ স্মৃতি! রয়ে গেল বাস্তচ্যুত প্রায় তিন লাখ মানুষের পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম সবচেয়ে বড় উদ্বাস্তু শিবির। টাইগারদের বিদেশ শাখা প্রধান সেলভরসা পরাজয় মেনে নিয়ে বিবৃতি দিলেন, ‘আমরা গোলাগুলি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের কেবল দূঃখ যে, এতগুলো মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, যা আর বইতে পারছিনা!‘

চুড়ান্ত সেনা অভিযানের বেশ আগেই এলটিটিইরা ধরে নিয়েছিল এ যাত্রায় তারা আর বাঁচবেনা। সারা বিশ্বের লাখ লাখ তামিল ডায়াসপোড়াদের মধ্যে মূহুর্তেই এর পূর্বাভাস ছড়িয়ে পড়ে। উত্তেজনায় ফেটে পড়েন তারা। সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ বোধ করি হয় কানাডার টরোন্টো ও অটোয়ায়। ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে তামিল ছাত্ররা তাদের মানবাধিকার লংঘনের আবেদনে সাধারণ ছাত্রদের সম্পৃক্ত করতে সক্ষম হয়। ‘নো মোর জেনোসাইড ইন দ্যা শ্রীলংকা’, ‘স্টপ দ্যা ওয়্যার ইন শ্রীলংকা’, ‘উই ওয়ান্ট সিজফায়্যার’, ইত্যাদি ব্যানারে হাজার হাজার তামিলদের আন্দোলন কানাডা মিডিয়াতে বেশ কভারেজ পায়। একটানা সপ্তাহব্যাপী রাস্তা অবরোধ করে তারা টরন্টো শহরতলী অচল করে দেয়। এতেও এলটিটিইকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণাকারী কানাডিয়ান রক্ষণশীল সরকারের সহানুভূতি লাভে ব্যর্থ হয়ে গভীর রাতে তামিলরা নেমে আসে অন্টারিও’র সবচেয়ে ব্যস্ততম রাস্তা গার্ডিনার এক্সপ্রেসওয়ের টরোন্টো উপকন্ঠে। দূর্ধর্ষভাবে রাস্তা ব্লক করে, শিশু-কিশোর-যুবকদেরকে রাস্তার সামনে বসিয়ে হারিকেন, মোমবাতি জ্বেলে তারা অভূতপূর্বভাবে বিক্ষোভ করে। রয়্যাল কানাডিয়ান মেট্রো পুলিশ এধরণের ‘অনিরাপদ, ঝুঁকিপূর্ণ’ ও আইন অমান্য’ কর্মসূচী প্রত্যাহার করতে ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালায়। শেষমেষ বিরোধী দলীয় নেতা মাইকেল ইগনাটিফ ও জ্যাক লেইটন শ্রীলংকার মানবাধিকার লংঘণের বিষয়টি পার্লামেন্টে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আন্দোলনকে কোনমতে প্রশমিত করতে সফল হন। টরোন্টোতে আনুমানিক চল্লিশ হাজার, অটোয়াতে ষাট হাজার মানুষ নিয়ে তারা বিক্ষোভ করে যার সাথে শুধুমাত্র সাম্প্রতিককালে বুশবিরোধী আন্দোলনেরই তুলনা করা যায়। লন্ডনসহ বিশ্বের অনেক বড় বড় সিটিতেই ভারতীয় ও শ্রীলংকান তামিলরা মিলে এরকম বিক্ষোভ করেছেন। উল্লেখ্য, তামিল বসবাসরত প্রত্যেক দেশেই গেরিলাদের প্রতি সহানুভূতিশীল তামিলভাষীদের বিভিন্ন নামে সংগঠন রয়েছে। তাদের উপার্জিত আয়ের একাংশ তারা স্বাধীন তামিল প্রতিষ্ঠার দাবীতে আন্দোলনরত প্রিয় যোদ্ধাদের তহবিলে জমা দিয়ে এতদিন একাত্মতা ঘোষণা করে আসছিল।

১৯৭৬ সালের ৫ মে ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণ তামিলদেরকে আজন্মশত্রু সিংহলীদের থেকে মুক্ত করতে টিএনটি (তামিল নিউ টাইগার) গোষ্ঠীকে দক্ষতার সাথে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এবং দূর্ধর্ষ কর্ম সম্পন্নকারী শক্তিশালী একটি এলিট ফোর্স গঠণ করেন। নতুন নামকরণ করেন ‘এলটিটিই (লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম)’। ২৩ জুলাই, ১৯৮৩ তারিখে উত্তর ও পূর্ব শ্রীলংকার তামিলাঞ্চল জাফনার বাইরে লংকান সেনাদের উপর প্রথম হামলা চালিয়ে ১৩ জন সেনা খতম করে এলটিটিই তাদের শক্তিমত্তা বহির্বেশ্বে প্রথমবারের মত জানান দিয়ে যায়। অন্যদিকে গোটা তামিল সম্প্রদায়ের ভেতর স্বাধীনতার স্বপ্ন নতুন করে বাসা বাঁধে। দলে দলে তরুনরা টাইগারদের সাথে যোগ দেয়। মুক্ত দেশ পাওয়ার নেশায় উন্মাদ হয়ে এক একজন ভয়ংকর ও দূর্ধর্ষ গেরিলা হয়ে উঠে। এমনকি জীবন বিনাশী ‘সায়ানাইড ক্যাপসুল’ সবসময় তাদের গলায় শোভা পেত। আক্রান্ত হলেই তারা বিষের এই ট্যাবলেট গিলে মুক্ত দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করত। যদিও নির্মম বাস্তবতা হল, এর প্রবক্তা প্রভাকরণ জীবনের কঠিন সায়াহ্নে ‘সিংহলী’ সেনাদের থেকে বিষ খাওয়ার সেই সময়টুকু পাননি। আরো একটি প্র্যাকটিস তাদের মধ্যে ছিলো তা হল ‘Oath of loyalty’; তামিলরাষ্ট্র গড়ার আনুগত্যের কঠিন শপথ।

প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ঘাঁটিসমূহে আত্মঘাতী আক্রমণ চালানোর ব্রত নিয়ে ১৯৮৭ সালে এলটিটিই সুইসাইড স্কোয়াড ‘ব্ল্যাক টাইগার’ গঠণ করে। এবছরই তারা একটি আর্মি ক্যাম্পে প্রথম হামলা চালিয়ে চল্লিশজন সেনা বধ করতে সক্ষম হয়। ব্ল্যাক টাইগারদের মনোবল বহুগুণে চাংগা হয়ে উঠে। ‘নিরাপদ-যোদ্ধা’ হিসেবে শত শত কিশোর ও মহিলাদেরকে তারা প্রশিক্ষিত করে বহু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহে ছেড়ে দিয়ে ‘সফল’ আক্রমণের পারদর্শীতা দেখাত।

এই যুদ্ধে ভারতও একসময় প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৮৭ সালে অগনতি হতাশ ও উদবাস্তু তামিলদের ভেতর আভ্যন্তরীন অসন্তোষ তীব্রভাবে দেখা দেয়। সুযোগটি ইন্ডিয়া ভালভাবে কাজে লাগায়। একসময় ইন্দো-শ্রীলংকা শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যদিও দ্বন্দ্বটি ছিল মূলতঃ সিংহলী ও তামিলদের মধ্যে। পঞ্চাশ হাজার ‘ইন্ডিয়ান পিস কিপিং ফোর্স (আইপিকেএফ)’ শ্রীলংকায় চলে আসে। তামিলদের ক্ষুদ্র কয়েকটি গ্রুপ এ চুক্তি মেনে নিলেও টাইগাররা মানতে পারেনি। তাদের পছন্দের প্রতিনিধিকেও অন্তর্ভূক্ত করতে রাজী হয়নি ভারত। এলটিটিই’র অস্ত্র এবার ঘুরে যায় ইন্ডিয়ান আর্মির দিকে। এবছরই ৮ অক্টোবর রেশন ট্রাকের উপর হামলা চালিয়ে পাঁচজন ভারতীয় প্যারা-কমান্ডোকে মেরে গলায় জ্বলন্ত টায়ার পেঁচিয়ে রাখে যোদ্ধারা। আত্মসম্মান বাঁচাতে বেপরোয়া হয়ে উঠে অজনোপ্রিয় আইপিকেএফ। ‘অপারেশন পবন’ নামে তামিল নিধনে নির্মম অভিযান শুরু করে। টাইগাররাও হিংস্র ও প্রতিশোধপরায়ন হয়ে ওঠে। আগে থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলীরা ভারতীয়দের হস্তক্ষেপ কোনমতেই মেনে নিতে পারেনি। ফলতঃ দুই বছরের বেশী সময় ধরে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি গুণে নাস্তানাবুদ হয়ে শ্রীলংকা সরকারের অনুরোধে ভারতীয় সর্বশেষ সৈন্যটি ফিরে যায় ১৯৯০ সালে। এইখানে পাঠকদেরকে যে বিষয়টি না জানালেই নয়, তাহলো প্রারম্ভে এলটিটিই গঠনে তরুন প্রভাকরনকে ভারত কর্তৃক সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ সবধরনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতার বিষয়টি। ৭০’র দশকে ইন্দিরা সরকার ভারতীয় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’কেও এর সাথে সম্পৃক্ত করে। এমনকি প্রভাকরনের একসময় অফিসও ছিল তামিলনাড়ুতে। ইন্দিরা গান্ধী কংগ্রেসের থলেতে ভারতীয় তামিলদের ভোট পাকাপোক্ত করতেই শ্রীলংকাবিরোধী আন্দোলনকে উৎসাহিত করেছেন যার শেষ হলো বহু বন্ধুর ও রক্তাক্ত পথ পাড়ি দিয়ে।

ভারতীয় শান্তি রক্ষী বাহিনী স্বদেশে ফিরে গেলেও প্রতিহিংসাপরায়ন টাইগারদের রাগ এতটুকুও কমেনি। সুযোগ খুঁজতে থাকে বদলা নেয়ার। সুইসাইড স্কোয়াড দলের ব্ল্যাক টাইগাররা স্বল্প সময়ের ব্যবধানে শান্তি চুক্তি সম্পাদনকারী দুই দেশের দুই রাষ্ট্রপ্রধানকেই নির্মমভাবে শেষ করে দেয়। রাজীব গান্ধীকে হত্যা করে ১৯৯১ সালে আর শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট রানাসিংহ প্রেমাদাসাকে ১৯৯৩ সালে।
তিন দশকের এই লড়াইয়ে যুদ্ধ-বিরতির হরেক রকমের প্রস্তাবনা এসেছে। স্বাধীন রাষ্ট্র থেকে সরে এসে স্বায়ত্বশাসন, স্পেশ্যাল স্ট্যাটাস কত কিছু! অন্ততঃ চারবার শান্তিচুক্তি ভেঙ্গে যায়। সর্বশেষটি ভন্ডুল হয় ২০০৬ সালে। তখন থেকেই শ্রীলংকান সেনাবাহিনী সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়ে এলটিটিইকে কোনঠাসা করে ফেলে। এরই ধারাবাহিকতায় এক সময় যারা দেশের এক তৃতীয়াংশ বা কমপক্ষে ১৫ হাজার বর্গকি.মি. এলাকা নিয়ন্ত্রণ করত সেই দুর্ধর্ষ ও অজেয় টাইগারদের তাড়িয়ে সেনারা মোল্লাইথিভু জেলার মাত্র ১.৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের জংগলের মধ্যে আটকিয়ে ফেলে করে। কট্টর তামিলবিরোধী প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাক্স তখন থেকেই বিজয়ের বার্তা গুণতে থাকেন। যাহোক, নৃশংস এই যুদ্ধে দুই পক্ষের প্রাণহানী হয়েছে প্রায় পৌণে এক লাখ বনি আদমের, বাস্তুচ্যুত ও ডায়াসপোড়া হয়েছে লক্ষ লক্ষ তামিল। উল্লেখ্য, শ্রীলংকার মোট জনসংখ্যা প্রায় তিন কোটি। এর মধ্যে ৭৪% বৌদ্ধ ধর্মানুসারী সিংহলী, মাত্র ১৮% তামিল হিন্দু, বাকী ৮% মুসলিম ও অন্যান্য।

শুরু থেকেই তামিল মুসলিম সম্প্রদায় প্রভাকরণের সাথে থাকলেও ক্রমান্বয়ে তিনি এলটিটিকে শুধুমাত্র হিন্দুদের বাহিনীতে পরিণত করেন। আশির দশক থেকে তিনি এলটিটিই নিয়ন্ত্রিত উত্তরাঞ্চল থেকে মুসলমানদেরকে সম্পূর্ণরুপে বিতাড়িত করার বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। সবচেয়ে বড় মুসলিমবিরোধী ক্যাম্পেইনটি শুরু হয় ১৯৯০ সালে। এ বছরে এক গ্রীষ্মেই উত্তরাঞ্চল থেকে ৩৭০ জন এবং পূর্বাঞ্চল থেকে ১১ জন মুসলিমকে হত্যা করে টাইগাররা। প্রচুর মাদ্রাসা-মসজিদ তছনছ করা হয়। কয়েক ডজন হাজীকে সৌদী থেকে ফেরৎকালে হত্যা করা হয়। গণহত্যার বাইরেও ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনেক নামকরা ও নামহীন মুসলমানদের অকাল সমাধি হয়। ১৯৮৯ সালের ২৮ অক্টোবর তারিখের মধ্যে ম্যানার অঞ্চলের মুসলমানদেরকে ভিটে-মাটি চিরতরে ছাড়ার নোটিশটি এভাবে দেয়া হয়, ‘ All Muslims living in Manner island should leave by 28 October. Before leaving, they must seek permission and clearance at the LTTE Office. The LTTE will decide their exit route’ (অর্থাৎ ম্যানার আইল্যান্ডের সব মুসলমানদেরকে ২৮ অক্টোবরের মধ্যে আইল্যান্ড ছাড়তে হবে এবং ছাড়ার পূর্বে অবশ্যই এলটিটিই অফিস থেকে অনুমতি ও ছাড়পত্র সাথে নিতে হবে। আর টাইগাররাই সিদ্ধান্ত নিবে কোন পথ দিয়ে তারা বের হয়ে যাবে।)

এলটিটিই’র শক্ত ও সুসংগঠিত মিলিটারী কাঠামো ছিল। আত্মঘাতী স্কোয়াড ‘ব্ল্যাক টাইগার’, সুসজ্জিত মেরিন বাহিনী ‘সি টাইগার’, এমন কি মডার্ণ একটি এয়ার ফোর্স ‘এয়ার টাইগার’ও ছিল (যা কিনা পৃথিবীর ইতিহাসে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত কোন গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে প্রথম বিমানবাহিনী), ইন্টেলিজেন্ট উইং, পলিটিক্যাল উইং সবই তাদের ছিল। উল্লেখ্য, এই সংগঠনটিকে আমেরিকা, কানাডা, বৃটেনসহ ৩২টি দেশ সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছিল।

মিলিটারী শক্তি হিসেবে প্রধাণত এলটিটিইর ব্যাপক পরিচিতি থাকলেও পর্যায়ক্রমে এরা নর্থ আইল্যান্ডের গোটা এলাকায় একটি ক্রিয়াশীল স্বঘোষিত বেসামরিক ‘গভর্ণমেন্ট’ সফলভাবে প্রতিষ্ঠা করতেও সক্ষম হয়। এই মিনি সরকারের অধীনে বিচারবিভাগ (ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট, হাইকোর্ট, সুপ্রীম কোর্ট, এমনকি আপিল কোর্ট) ছিল। ধর্ষণ, খুন-খারাবি, চাঁদাবাজি ইত্যাদি অপরাধসমূহ বিচারের জন্য দুটো হাইকোর্ট আর তামিল ইলমদের বিচারের দায়িত্বে ছিল সুপ্রীম কোর্ট। বিচার বিভাগ ল’বুকের আপডেট ভার্সনও বের করত। টাইগাররা দাবী করত তাদের বিচারালয় ও নিজস্ব পুলিশবাহিনী সক্রিয় থাকায় জাফনাঞ্চলে তুলনামূলকভাবে অপরাধপ্রবণতা অনেকাংশে কম ছিল। যদিও সমালোচকরা বলে থাকেন, এই পুলিশবাহিনী স্বেচ্ছাচারী এলটিটিই’র আজ্ঞাবহ থাকায় জনসাধারণ সারাক্ষণ ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকত।

সামাজিক নিরাপত্তা ও মানবিক দিকসমূহ দেখভালের জন্য টাইগাররা সোশ্যাল ওয়েলফার চালু করেছিল। ফান্ডে টাকা আসত জনগণের কাছ থেকে ট্যাক্স ও বিদেশ থেকে সহানুভূতিশীল সংগঠনসমূহ থেকে। এই অর্থ তামিলদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করত। অভিন্ন শিক্ষা পদ্ধতির জন্য সুন্দর একটা স্কুলিং সিস্টেমও তারা প্রণয়ন করেছিল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় স্বীকৃতি না দিলেও এলটিটিই নিজেদের জন্য বানিয়েছিল একটা হিউম্যান রাইট্‌স কমিশন।

‘ভয়েস অব টাইগারস্‌’ নামে একটি রেডিও স্টেশন এবং ‘ন্যাশনাল তামিল ইলম টেলিভিশন’ নামে একটী টিভি স্টেশন টাইগার নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে সম্প্রচারিত হত। ‘ব্যাংক অব তামিল ইলম’ নামে উচ্চসূদের একটি ব্যাংক তাদের ছিল। প্রশাসনিক রাজধানীর নাম ছিল কিলিনোচছি। ২০০৪ সালের প্রলয়ংকরী সুনামীর তান্ডবে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের জন্য এলটিটিই ‘সুনামি টাস্ক ফোর্স’ গঠণ করে সাধারণ মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে বিশ্বসম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়।
তাদের মহিলা শাখাটিও ছিল খুব শক্তিশালী। চরম পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিগৃহীত, নির্যাতিত ও অবহেলিত মহিলাদেরকে টাইগারদের ‘নারী-স্বাধিকার’ অবস্থান বেশ আকর্ষণ করেছিল। জীবনের ঝুঁকি উপেক্ষা করে নিম্নবর্ণ ছাড়াও অপ্রত্যাশিতভাবে অগণতি শিক্ষিত ও উচ্চ শ্রেণীর মেয়েরাও এতে যোগ দেয়। আনুমানিক চার হাজার মহিলা ক্যাডার ছিল। এদের মধ্যে একশোজন আত্মঘাতী ‘ব্ল্যাক মহিলা টাইগার’ সদস্য প্রাণ হারায়। ‘ফ্রিডম বার্ড’ নামে তাদের প্রথম অপারেশনটি হয় ১৯৮৭ সালে এবং প্রথম আত্মঘাতী মহিলা যোদ্ধার নাম ‘মালতি’। যুদ্ধ-বিগ্রহ ছাড়া সাংস্কৃতিক ও প্রকাশনা অংগনেও মহিলা টাইগারদের প্রবল পদচারণা ছিল। মোদ্দাকথা, তারা তাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে চমকপ্রদ ও সৃষ্টিশীল নানান কর্মকান্ডের মাধ্যমে শ্রীলংকান তামিল ছাড়াও সারা বিশ্বের তামিলদের একচ্ছত্র সমর্থন লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। এমন একটি সুসংগঠিত ও সুসজ্জিত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী গেরিলা গোষ্ঠীর সর্বশেষ পরিণতি অনেককেই হতভাগ করেছে। ধরাছোঁয়ার বাইরে ত্রাস সৃষ্টিকারী,তামিল কমিউনিটির অবিসংবাদিত ও অপ্রতিরোধ্য প্রবাদপুরুষ ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের ক্ষুদ্র একটি প্রাইভেট কার যোগে জংগল থেকে পলায়নরত অবস্থায় সিংহলী সেনাদের হাতে রুগ্ন মেষশাবকের ন্যায় করুণ মৃত্যু হয়েছে। বিশ্ববাসীকে নিশ্চিত করতে মৃত্যুর পরে টাইগার প্রধাণের মরা-মুখ এদিক ওদিক ঘুরিয়ে তামিলভূমি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন-সাধ চিরতরে মিটানোর দৃশ্য সরকারী টিভি চ্যানেলে প্রদর্শিতও হয়েছে যা কেউ আগে ভাবতেই পারেনি। স্বাধীনতার পর থেকে সংখ্যাগুরু সিংহলীরাই দেশ চালাচ্ছে যাদের পূর্ব-ইতিহাসে অন্যান্য গোষ্ঠীর সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগির রেকর্ড খুব বেশী নাই। যুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতিতে পরাজিত ও বিধ্বস্ত তামিল জাতির সাথে তারা কেমন আচরণ করবে তাই-ই এখন দেখার বিষয়।

Friday, March 27, 2009

দূঃসময়ের সাক্ষী



‘ফরেন পলিসি’ নামে একটি আমেরিকান থিঙ্ক ট্যাঙ্ক কোনো দেশের বিদ্যমান রাজনীতি, মিলিটারি, অর্থনীতি ও সামাজিক উপাদানগুলোর প্রধানত ১২টি সূচক নিরীক্ষা করে ‘ব্যর্থ বা অকার্যকর রাষ্ট্র’-এর সার্টিফিকেট ইস্যু করে থাকে। এগুলোর মধ্যে সংবিধান অবজ্ঞা, নিরাপত্তাহীনতা, প্রতিরাহীনতা, বাজে অর্থনীতি এবং অসম উন্নয়নের পাশাপাশি পাবলিক সার্ভিস, মানবাধিকার, মানবপাচার, ভূরাজনৈতিক চাপ এবং বহির্দেশীয় হস্তক্ষেপ প্রভৃতি উলেখযোগ্য। প্রতিটি পয়েন্টে দেশের মধ্যে গড়ে সাড়ে ৯ এবং সর্বমোট ১১৪ দশমিক ২ পয়েন্ট পেয়ে শীর্ষস্থান অধিকার করায় ‘ব্যর্থ রাষ্ট্রে’র খেতাবটি সোমালিয়ার কপালে জুটেছে। সুদানের ঝুলিতে ১১৩, জিম্বাবুয়ের ১১২ দশমিক ৫, শাদের ১১০ দশমিক ৯ এবং ইরাকের ভাগে পড়েছে ১১০ দশমিক ৬ পয়েন্ট করে।

এ ব্যাপারে কোনোই সন্দেহ নেই যে, সোমালিয়া বর্তমানে এমনই এক দেশ যেখানে শান্তি নেই, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন তো দূরের কথা দুই দশক ধরে কার্যকর কোনো সরকারও নেই সেখানে। সব জাতীয় প্রতিষ্ঠান অকার্যকর থাকায় দেশটির নেগেটিভ ইমেজ বিশ্বে বহুল পরিচিত।

কী কারণে সোমালিয়া এ পর্যায়ে এসে পৌঁছল? কারাই বা এর জন্য দায়ী? এ থেকে বাংলাদেশের এ মুহূর্তে কি কিছু শেখার রয়েছে? সোমালিয়ানরাও তো আমাদের মতো হোমোজিনিয়াস বা সমসত্ত্ব জাতি! তারা সবাই দেখতে মোটামুটি একই রকম। একই ভাষা, বর্ণ এবং শতকরা ১০০ ভাগ অভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মধ্যে কোন বিরোধের ফলে বর্তমানে তাদের এই লজ্জাকর পরিণতি? আমাদের মতো সাহিত্য-সংস্কৃতিপ্রেমিক এবং বিজয়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্যসমৃদ্ধ এককালের গর্বিত দেশ সোমালিয়া কেনইবা গৃহযুদ্ধ, অরাজকতা ও লুটপাটের রাজত্বে পরিণত হয়ে গেল?

সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত সোনালি অধ্যায় ছিল সোমালিয়ার। তাদের নতুন নতুন অনেক শহর তৈরি আর অবিশ্বাস্য রকমের উন্নয়নের স্মৃতি পুরনো দিনের ঢাকার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। নবম শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত হয় ইউরোপের বড় বড় শহরের একই আদলে মোগাদিসু শহর। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা চলে পনেরো শতক পর্যন্ত। সুলতান আহমদ ইবনে ইব্রাহিম আল গাজীর নেতৃত্বে ১৫৪৩ সালে সোমালিয়ানরা ‘ওইনা দাগা’র যুদ্ধে ইথিওপিয়ান-পর্তুগিজ যৌথ বাহিনীকে পর্যদুস্ত করে ইথিওপিয়ার তিন-চতুর্থাংশ দখল করে নেয়। এরপর ফ্রেঞ্চ, ব্রিটিশ, ইতালী অনেকেই এলো। সোমালিয়ান বীর, প্রবাদপুরুষ মুহাম্মদ আবদুলাহ হাসান হজ্জ্ব থেকে ফিরে এসে দেখেন, তার দেশ ব্রিটিশ কলোনির অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। এমনকি, ব্রিটিশ সৈনিকরা আবদুলাহকে নিজ দেশে ঢুকতে পর্যন্ত বাধা দিয়ে বিনিময়ে অর্থ দাবি করেছিল। অগ্নিমূর্তি ধারণ করে হাজী আবদুলাহ হাসান চড় মেরে বসেন দখলকারী এক ব্রিটিশ সেনাকে। অল্প সময়ের মধ্যেই অজেয় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ব্রিটিশরা তাই তার নাম দেন ‘ম্যাড মোলা’। ১৯৩৬ সালের মোগাদিসু টাউনের ছবি দেখলে সহজেই লালবাগের কেলা বা সোনারগাঁওয়ের পুরান চেহারা যে কারো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করবে।

‘আফ্রিকার শিং’ বা ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ বলা হয় সোমালিয়াকে। আরব সাগর ও লোহিত সাগরের কোল ঘেঁষে ইরিত্রিয়া, জিবুতি, ইথিওপিয়া ও সোমালিয়া মিলে মানচিত্রে গণ্ডারের শিঙের আকৃতির মতো দেখায় বলেই জায়গাটির এ নামকরণ। লোহিত সাগরের মুখে অবস্থান বলে সোমালিয়া মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার সাথে ব্যবসায়-বাণিজ্যে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। ভারত সাগরও এখানে এসে মিলেছে। অন্যভাবে বলা যায়, গুরুত্বপূর্ণ এই ভৌগোলিক কৌশলগত অবস্থানই সোমালিয়ার ওপর সাম্রাজ্যবাদীদের লোলুপদৃষ্টির মূল কারণ। বর্তমানে ঠিক বঙ্গোপসাগর ও চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে এমন চক্রান্তই চলছে। প্রায় ৬ লাখ ৩৮ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের সোমালিয়ায় আনুমানিক ১৪ মিলিয়ন জনসংখ্যার বেশির ভাগ বাস করেন উর্বর ভূমি, বিশেষত জুবা ও শেবেল নদীর উপকূলবর্তী অঞ্চলে। মাত্র ১৫-২০ ভাগ মানুষের বাস শহরাঞ্চলে।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় (১৯৬০) সোমালিয়া আফ্রিকার গ্রামীণ গণতন্ত্রের মডেল বলে পাশ্চাত্যে খ্যাতি লাভ করেছিল। ১৯৬৯ সালে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্যে আর্মি কমান্ডার সাঈদ বারী (সোমালিয়ানরা তাকে সিয়াদ বারী বলে ডাকেন) ততকালীন প্রেসিডেন্ট আবদুর রশিদ আলী শেরমার্ককে হত্যা করে মতা দখল করেন। তিনি সোমালিয়ার ঐতিহ্যের সাথে সঙ্গতি রেখে গড়ে তোলেন চীনের আদলে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’। নিজেকে ঘোষণা করেন জ্যালে সাঈদ বা কমরেড সাঈদ হিসেবে। রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সোমালিয়ানদের জন্য অনেক ভালো কাজও তিনি করেছেন। নিচু থেকে উচ্চ সব পর্যায়ের শিক্ষাই সবার জন্য বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক করেছিলেন। শিক্ষালয়ে প্রত্যেকের জন্য কুরআন শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেছিলেন, যার কারণে এখনো সব সোমালিয়ানই সুন্দর করে কুরআন তিলাওয়াত করতে সম। সার্বজনীন রূপ দিতে সোমালিয়ান ভাষা রোমান হরফে লেখা চালুর ব্যবস্থা তিনিই করেছেন, যেমনটি মালয় ভাষার ক্ষেত্রে মাহাথির মোহাম্মদ করেছেন। একটানা ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থেকে ‘লাল ঘোড়া দাবড়িয়ে’ বেড়ান কমরেড সাঈদ বারী।

সোমালিয়াকে আয়ত্তে রাখা দুই পরাশক্তি আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এর মূল কারণ আমরা আগেই বলেছি। সাইদ বারীকে এক পর্যায়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ত্যাগ করলে ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি তাদের সাথে আগের সব মৈত্রী চুক্তি বাতিল করে দেন। বহিষ্কার করেন স্পর্শকাতর বিভাগগুলোতে কর্মরত ডজন ডজন রুশ উপদেষ্টা। আনুগত্যের মস্তক এবার ঝুঁকে পড়ে পাশ্চাত্যের দিকে। দেশটির পতন মূলত তখন থেকেই শুরু হয়। সোমালিয়ানরা বলে থাকেন, রাশিয়ার কথা মতো ১৯৭৭-৭৮ সালে ইথিওপিয়া আক্রমণই ছিল বারী প্রশাসনের সবচেয়ে বড় ভুল, ঠিক সাদ্দাম হোসেন যেমন আমেরিকার ভুয়া প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ইরাক ধ্বংসের বীজ বুনেছিলেন কুয়েত আক্রমণ করে। ইথিওপিয়ার দখলকৃত ঔপনিবেশিক আমলের সোমালিয়ার দ্বীপগুলো (যেগুলোতে এখনো সোমালিয়ানভাষীরা বাস করেন) কব্জা করার পর সোভিয়েত ইউনিয়ন সোমালিয়া থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। কিউবা ও সোভিয়েত মিলে সাঈদ বারীর অপ্রতিরোধ্য হস্ত সঙ্কুচিত করতে বাধ্য করে। এই অঞ্চলে নৌ-স্থাপনার মোক্ষম সুযোগ ভেবে সাঈদ বারীর ‘নতুন প্রেমিক’ বেশে আসে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ওদের আশীর্বাদ অব্যাহত থাকে। বিনিময়ে জোটে অর্থনীতি ও সামরিক খাতের নাম করে বছরপ্রতি ১০০ মিলিয়ন ডলারের ‘প্যাকেজ ডিল’, ঠিক যেমনটি জেনারেল পারভেজ মোশাররফ পেয়েছেন বুশের তথাকথিত ওয়ার অন টেররের প্রেমিক সেজে।

সোমালিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্র করতে একনায়ক সাইদ বারীকে আমেরিকা ও রাশিয়া ইচ্ছামতো ব্যবহার করেছে। আরেকটি সত্য কথা হলো, বাংলাদেশের মতো সোমালিয়ারও কপাল খারাপ। ভালো প্রতিবেশী নেই। পূর্ব থেকেই সোমালিয়াবিরোধী কর্মকাণ্ড ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন প্রতিবেশী দেশ ইথিওপিয়া থেকে উতসারিত হয়ে আসছে। ওদিকে ইথিওপিয়া হলো পরাশক্তির আজ্ঞাবহ। গোত্রীয় বা গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব সোমালিয়াতে আগে থেকেই ছিল। দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত স্বৈরাচারী বারী প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণহীনতার সুযোগে সেটিও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বিদ্রোহী ব্যবসায়ী নেতা আলী মাহদি এবং মিলিটারি কমান্ডার ফারাহ আইদিদ মোগদিসু আক্রমণ করে বসেন। ১৯৯১ সালের ২৬ জানুয়ারি বারী যুগের অবসান ঘটে। তারপর যা হওয়ার তাই-ই শুরু হয়ে গেল। রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনী বলে কিছু রইল না। কমান্ড, শৃড়খলা একে একে খসে পড়ে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ল সোমালিয়া। অস্ত্র চলে গেল ট্রাইবাল লিডার, গডফাদার ও দস্যুদের (যারা সমুদ্রের জাহাজ পর্যন্ত ছিনতাই বা জিম্মি করে অর্থ দাবি করে) হাতে। শুরু হলো অরাজকতা, ডাকাতি ও লুটপাটের রাজত্ব। দুঃসময়ের সাক্ষী সোমালিয়ানরা স্ববদেশভূমি ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন পৃথিবীতে। ১০০ শতাংশ শিতি এবং অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ সোমালিয়ান জাতি এবং এক সময়কার ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড’দের নতুন পরিচয় হলো ‘যাযাবর’। অকার্যকর তত্ত্বের এ যেন সফল কার্যকরণ!

১৯৭৫ সালের আরেক ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ সিকিমের কাহিনীও মোটামুটি একই রকম। দুঃসময়ের এ যেন আরেক সাক্ষী। মাত্র ৭ হাজারের একটু বেশি বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ক্ষুদ্র রাষ্ট্র সিকিমকে ভারত ২২তম প্রদেশ বানিয়ে অন্তর্ভুক্ত করার আগ পর্যন্ত ৩০০ বছর ধরে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী চোগিয়াল রাজারা শাসন করতেন। মানুষগুলো সবাই দেখতে একই রকম। বেশির ভাগই নেপালি বংশোদ্‌ভূত এবং হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। হিমালয়ের পাদদেশে ছবির মতো সাজানো একটি দেশ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ও প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন, সিকিমের পুরনো নাম হিন্দু ধর্মের দেবতার নামানুসারে ছিল ‘ইন্দ্রকিল’ অর্থাত ইন্দ্র দেবের বাগান। মানচিত্রে বুড়ো আঙুলের মতো দেখতে। সিকিমের চার পাশে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ, ভুটান, চীনের তিব্বত ও নেপাল। বিশ্বের পর্যটকদের কাছে ‘হট স্পট’ বলে পরিচিত ছিল সিকিম। কিন্তু ষড়যন্ত্র তাদেরকেও ছাড়েনি।

সিকিমের সর্বশেষ যুবরাজ পলডেন নমগিয়াল মতা গ্রহণের আগে ১৯৬০ সালে নিউইয়র্ক পরিভ্রমণ করেন। তখন সাক্ষাত মেলে আমেরিকান ধনাঢ্য মেয়ে হোপ কুকের। বৌদ্ধ রীতি অনুযায়ী বিয়েও করেন তাকে। বৃদ্ধ রাজা তাশি নমগিয়াল মারা যান ১৯৬৩ সালে। এবার নতুন ও সর্বশেষ চোগিয়াল রাজা হলেন আমেরিকান মেয়ের বর পলডেন। ভারতের আশীর্বাদ নিয়ে গঠন করেন মন্ত্রিসভা। এই অসময়ে প্রতিবেশী অন্য দেশগুলোতেও রয়েছে ভারতের ‘পরীক্ষিত-বন্ধুরা’ ক্ষমতায়। রাজ্য হারানোর মর্মান্তিক গল্পের শেষ অধ্যায় হলো, ১৯৭৩ সালে হঠাত দেশব্যাপী শুরু হয়ে যায় চরম গোলযোগ ও অস্থিরতা। রাজা পলডেনের অমতা সম্পর্কে ভালো করেই জানা ছিল ভারতপন্থী সব বলয়ের। সিকিমের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা তো চুক্তি অনুসারে বরাবরই ভারতের হাতে। নেহেরু ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে এভাবেই শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেয়ার মতো সিকিমের কথিত স্পেশাল স্ট্যাটাসের ব্যবস্থা করে রেখে গিয়েছিলেন। ভারতীয় গণমাধ্যম ইতোমধ্যে সার্থকভাবে বিশ্বব্যাপী প্রচার করে সিকিমের বিরুদ্ধে ‘অকার্যকর রাষ্ট্রের তত্ত্ব’। এরই ধারাবাহিকতায় সুযোগ বুঝে ১৯৭৫ সালে দেশটিকে সম্পূর্ণভাবে গিলে ফেলে ভারত। সর্বশেষ রাজা পলডেন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান শ্বশুরবাড়ি নিউইয়র্কে ১৯৮০ সালে।

বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিত আমরা বলতে পারি, আমাদের প্রিয় দেশটি সোমালিয়া বা সিকিম হওয়ার পর্যায়ে আসেনি। আমাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আবারো ঘুরে দাঁড়াবে, ‘কমান্ড অব চেইন’ দ্রুত ফিরে আসবে, শোককে শক্তিতে পরিণত করে আবার সম্মুখপানে আমাদের সেনারা ধাবিত হবেন, অন্তত এ আশাটুকু করতে চাই। যত অপপ্রচারই চালানো হোক না কেন, কারো সাধ্য নেই এ দেশকে ‘অকার্যকর রাষ্ট্রে’ পরিণত করা। অনেক চেষ্টা করে ভুটানকেও পারেনি। ভুটান আজ নিজ্ব প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলছে। নেপালে অনেকবার ‘প্রো-ইন্ডিয়ানরা’ শাসন করেছেন, এমনকি ভারতীয় সেনাবাহিনী পর্যন্ত সেখানে দীর্ঘদিন মোতায়েন থেকেছে। কাজ হয়নি। বরঞ্চ ভারতবিরোধী শক্তিই দিন দিন বেড়েছে সেখানে। মাওবাদীরা আজ নেপাল শাসন করছেন। শ্রীলঙ্কার অবস্থাও অনুরূপ। কোনো প্রতিবেশীই ভারতের ‘অবিশ্বাসী প্রভুত্ব’ চায় না। বৃহত রাষ্ট্রের উসকানিমূলক প্রচারণা এবং তথাকথিত গবেষণা প্রতিবেদন বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রতিফলিত না হলে জাতি তার অস্তিত্ব সঙ্কটে কখনো পড়বে না।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, মোট চারটি উপাদান নিয়ে একটি কার্যকর রাষ্ট্রের সংজ্ঞা নিরূপিত হয়। জনগণ, সরকার, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড ও সার্বভৌমত্ব। শেষোক্ত দু’টি উপাদানের মূল নিয়ন্ত্রণকারীদের বাংলাদেশে আমরা নাম দিয়েছি বাংলাদেশ রাইফেলস ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। যদি রাষ্ট্রের উপরি উক্ত উপাদানগুলোর ভঙ্গুরতা সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া যায়; অর্থাত বিভাজিত জনগণ, একদেশদর্শী কিংবা বিদেশপ্রেমিক সরকার এবং সার্বভৌমত্ব ও ভূখণ্ডের নিরাপত্তাহীনতা, তখনি কথা এসে যায় অকার্যকর বা ব্যর্থ রাষ্ট্র হওয়ার। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর একটা সুশৃংখল বাহিনীকে শেষ করে ফেলার অপপ্রয়াসের মতো নির্মম ঘটনা এ দেশে ঘটেনি। এর চেয়েও নির্মম সত্য হলো, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর এমন গুরুতর হামলাও জাতিকে বিভাজনের হাত থেকে রক্ষা করতে পারল না। বরঞ্চ স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্ম ও বাংলাদেশের শত্রুরা এই সুযোগে ভালো করে আবারো বুঝে নিলো, বর্তমানের অপরিচ্ছন্ন ও নোংরা রাজনীতি কোনো কিছুতেই এই জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারবে না; এমনকি দেশের অস্তিত্বের ওপর চূড়ান্ত হামলা এলেও! অধিকন্তু দিনে দিনে আশঙ্কা বেড়েছে, উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত নব নব উদ্ভট এবং বিভক্তি উতপাদনের বিকৃত বীজ প্রজন্মের পর প্রজন্ম বহন করে চলতে পারে। এভাবে চলতে থাকলে আজ থেকে ২০ বছর পর ভবিষ্যত বাংলাদেশের চেহারা কেমন হবে? নাইন-ইলেভেন আমেরিকানদের অনেক কিছু শেখালেও ওয়ান-ইলেভেন মনে হয় আমাদের কিছুই শেখায়নি! স্কটিশ একটি প্রবাদবাক্য হলো, ‘জোর করে ঘোড়াকে পানির কাছে নেয়া যায়, কিন্তু তাকে পানি পান করানো যায় না।’ ঘুমের মানুষকে জাগানো যায়, কিন্তু যারা জেগে ঘুমায়, তাদের জাগাবে কে?

Friday, February 6, 2009

‘শান্তির স্বপ্নে’ও প্রেতাত্মার থাবা


সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় ‘ইন দ্যা লাইন আব ফায়ার’ (প্রকাশঃ সেপ্টেম্বর ২৫, ২০০৬) নামে আত্মজীবনী মূলক বই লিখে পাকিস্তানের স্বৈরশাসক পারভেজ মোশাররফ সারা দুনিয়ায় হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন। তখন তার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠেছিল। তিনি নাকি বইতে কারগিল যুদ্ধ, বিজ্ঞানী কাদির খান ইত্যাদি নিয়ে অর্ধসত্য বা মিথ্যা কথা বলেছেন।পাকিস্তানের নিরাপত্তার স্বার্থ বিঘ্ন হতে পারে এমন অনেক বিষয়ে তথ্য পাচারের বিস্তর অভিযোগ উঠলেও ঐবছর তার বইয়ের ব্যাপক কাটতি কিন্তু কেউ আটকাতে পারেনি। আর তাবৎ বিশ্ব ভাল করেই জানে, দু’একটি পরাশক্তি হাতে থাকলে বড়-ছোট কোন অভিযোগই কিছুদিন পরে আর অবশিষ্ট থাকে না। আমেরিকা, বৃটেন কিংবা উন্নতবিশ্বে সেনাপ্রধান কে বা তিনি কিইবা বললেন তা নিয়ে দুনিয়ার মানুষ খুব বেশী মাথা ঘামায় না।কারন তাঁরা সরকারী চাকুরিজীবি, অর্পিত দায়িত্ব পালন করাই তাঁদের কাজ।কিন্তু আমাদের মত দেশগুলো বিশেষ করে পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, বাংলাদেশ, ফিজি ইত্যাদির পরিস্থিতি সম্পূর্ণ উলটা। কারণ ইনারা সরকারী চাকুরির পাশাপাশি ‘উপরি’ কিছু দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এই উপরিই তাঁদের অতিরিক্ত পরিচয় বাড়াতে সাহায্য করে।


প্রজাতন্ত্রের এমন গুরুত্বপূর্ণ আসনে আসীন ব্যক্তিবর্গ সাধারনত চাকরি থেকে অবসরে গিয়ে আত্মজীবনীমূলক বই লিখে থাকেন। কখনো তাঁরা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট অনেক অপ্রিয় সত্য কথা সারা জীবনের জন্য চেপেও যান।যেমন, বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমেদ।একটি দলের উপর তিনি এতই মনক্ষুন্ন যে, আত্মজীবনীমূলক বই লেখার ইচ্ছা এখন আর করেন না।উল্লেখ্য, সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদের চাকরির মেয়াদ শেষ হয়েছে আগেই।তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৮ সালে আরো এক বছর বাড়িয়ে দিয়েছেন।তখন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্তব্য করেছিলেন, ‘মেয়াদ আর কত বাড়বে? সবকিছুর একটা শেষ আছে।’


যাহোক, সেনাপ্রধান জেনারেল মইনের আত্মজীবনীমুলক বই ‘শান্তির স্বপ্নে সময়ের স্মৃতিচারণ’ বেরিয়েছে।জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক বিশ্লেষকেরাই বিচার করবেন গুরুত্বপূর্ণ কোন গোপন তথ্য জেনারেল তিনি জনগনকে জানিয়েছেন কি না অথবা সেগুলো বাইরে জানানোর আদৌ প্রয়োজন রয়েছে কিনা।আমরা সেদিকে না গিয়ে বইয়ে বর্ণিত বহুলখ্যাত ‘ওয়ান-ইলেভেন’-এর অজানা রহস্য ও সেসময়ে প্রকাশিত জনপ্রিয় দেশী ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মিডিয়া বিবেচনা করে আলোচনা করব।আর শেষে তৃতীয় বিশ্বের অনেক সেনাপতির ঘনিষ্ঠ বন্ধু বুশকে নিয়ে একটি গল্প দিয়ে আজকের নিরস আলোচনাটির সমাপ্তি টানবো।


জরুরী অবস্থা না এলে হয়তো আমরা জানতেই পারতাম না জেনারেল মইনের রয়েছে অসাধারন লেখনী ক্ষমতা। সুন্দর ভাষা ও শব্দ চয়নে ইতিবাচক কলাম লিখে তিনি ইতোমধ্যে পরিচিতি লাভ করেছেন।বাংলা নববর্ষ ১৪১৫ (১৪ এপ্রিল ২০০৮) নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর একসাথে প্রকাশিত অসাধারন লেখাটি পজেটিভ বাংলাদেশ গড়তে বেশ সাহায্য করবে।তিনি আশাবাদী ও স্বপ্নবিলাসী মানুষ যা নিজেই বলে থাকেন।সেজন্যই হয়তোবা ওয়ান-ইলেভেন আনতে সহায়তা করেছেন।সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ বা মন জয় করতে নিজস্ব ব্র্যান্ডের গনতন্ত্র, ২৮শে অক্টোবর, জাতির জনক, স্বাধীনতার ঘোষক ইত্যাদি ইস্যু নিয়ে জনপ্রিয় কথাও বলেছেন।যেরকম আমরা এরশাদের মুখ থেকে ক্ষমতা দখল করে নেয়ার পরে দূর্নীতি ও অশ্লীলতার বিরুদ্ধে প্রায়শই শুনতাম।এমনকি দূর্নীতির এই বরপুত্র কৃচ্ছতা সাধনের নিমিত্তে মিডিয়াকে খবর দিয়ে সাইকেল চালিয়েও একসময় অফিস করতেন।


এক-এগারোর সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নায়কদের মুখ থেকে আমরা এর অন্তর্নিহিত রহস্য আগে জানতে পারিনি। শুধু জেনেছিলাম এটি পূর্বপরিকল্পিত।জেনারেল মইন বইতে এর বিস্তারিত বিবরন দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘১১ জানুয়ারি খুব ভোরে উঠে ফজরের নামায পড়ে কায়মনে আল্লাহর কাছে হাত তুলে বললাম, হে আল্লাহ, জীবনে আমি অনেক ভুল করেছি………....... মোনাজাত শেষ করে আমি অফিসের সময় শুরু হওয়ার আগেই অফিসে চলে এলাম। প্রথমে খবর ও পরে জাতিসংঘ সদর দপ্তর থেকে টেলিফোন পেলাম। আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল মিঃ গুইহিনো কোনোরকম ভনিতা না করেই জানালো, সব দলের অংশগ্রহণ ব্যতীত নির্বাচন তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এরকম একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যদি ভূমিকা রাখে তাহলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার করার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হবে। অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের ব্যাপারে জাতিসংঘের এরূপ কঠোর হুঁশিয়ারির পর আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, এমন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তিকে বিতর্কিত করে তুলবে।’ তাহলে বোঝা যায়, জাতিসংঘের কঠোর হুঁশিয়ারীই তাঁকে ১-১১ আনতে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে। আসলে সত্যি কি এরূপ ঘটেছিল? কোনো স্বাধীন রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীন ইস্যুতে জাতিসংঘ কি এমন অশোভন হুমকি দিতে পারে? ইকোনোমিস্ট ২১ ফেব্রুয়ারী ২০০৭-এ এক মন্তব্য প্রতিবেদনে লিখেছে, ‘They must have known that the United Nation’s threat was almost certainly hollow. After all, Pakistan and Fiji didn’t lose their peacekeeping contract after coups in their countries (অর্থাৎ বাংলাদেশের জেনারেলরা অবশ্যই নিশ্চিত ছিলেন যে, ইউএনের এই থ্রেটটা ছিল একটা ফাঁকা বুলি। কারন পাকিস্তান ও ফিজিতে জেনারেলরা ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়ার পরেও তাদের সাথে ইউএন’র পিসকিপিং কন্ট্রাক্ট কিন্তু বাতিল হয়ে যায়নি।)’


আমেরিকা অঞ্চলের মানবাধিকার আইনজীবীদের সংগঠন ‘আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব জুরিস্ট’র কানাডা চ্যাপ্টারের সভাপতি এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নিয়ে কর্মরত ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব ডেমোক্র্যাটিক ল’ ইয়ার্সের কর্মকর্তা অ্যাটর্নি উইলিয়াম স্লোন ২০০৮ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্ক ভিত্তিক ‘ফেডারেশন অব অর্গানাইজেশন্স এগেইনস্ট বাংলাদেশ ওয়ার ক্রিমিনালস’ নামক একটি সংগঠন কর্তৃক আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানি স্টাইলে বাংলাদেশে মাইনাস টু ফর্মুলা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা হঠাৎ করে আসেনি। ১-১১-এর পরিস্থিতিও পূর্বপরিকল্পিত।নির্বাচনের ইস্যুকে কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকায় প্রকাশ্যে পিটিয়ে মানুষ হত্যার নীলনকশাও পুরনো।‘পিলে চমকানোর মতো এসব তথ্য ফাঁস করে জ্যাকসন হাইটসে উইলিয়াম আরো জানিয়েছিলেন, ‘খালেদা জিয়ার সরকার পদত্যাগের সাথে সাথে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নির্বাচনের ইস্যুতে কী ধরনের আন্দোলন হবে এবং নির্বাচন বানচালের জন্য কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির অবতারণা করা হবে, এরপর জরুরী আইন হতে পারে, জরুরী আইনের সময় সামরিক বাহিনীকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেয়া হবে, এমনি অবস্থায় চালানো হবে দুর্নীতি দমন অভিযান এবং সে অভিযানের টার্গেট হবেন দুই নেত্রী, সংস্কারের নামে প্রধান দু’টি দলকে ভেঙে চুরমার করার পর আমেরিকার পছন্দের লোকদের নেতৃত্বে গঠন করা হবে নতুন রাজনৈতিক ফ্রন্ট এবং নির্বাচনের মাধ্যমে সেই ফ্রন্টের লোকজনের সমন্বয়ে সরকার গঠন করা হবে।’ তিনি দাবী করেন এসব অনেক আগেই এক ডেইলির সম্পাদক ও এক এমপির মাধ্যমে তিনি জেনেছিলেন । (সূত্রঃ নয়াদিগন্ত মার্চ১০, ২০০৮) সে সময় ডঃ কামাল হোসেনও বলেছিলেন, ‘এক-এগারো আমরাই এনেছি।’ সেসময়ে কারাধীন শেখ হাসিনার এক অভিযোগের বিষয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ডঃ কামাল হোসেন আরো বলেছিলেন, ‘দেশ গোল্লায় যাক। তাই বলে দুই নেত্রীকে পূজা করতে হবে নাকি? (আমারদেশ, মে১, ২০০৮)’

তাহলে আমরা কি করে বিশ্বাস করবো সব বাহিনীর প্রধান জেনারেল মইন এসবের কিছুই কি অগ্রিম জানতেন না বা এর সাথে নিজেকে কখনো অন্তর্ভূক্ত করেননি? না কি ধরে নিব অদৃশ্য কোনো প্রেতাত্মার থাবা আমাদের সাহসী সেনাপতিকেও নির্মম সত্য প্রকাশে টুটি চেপে ধরেছে?


আমরা ১-১১ পূর্ব-প্রেক্ষাপটটি বিবেচনায় আনলে সহজেই বুঝতে পারি শক্তিধর রাষ্ট্রদূতদের সাথে সবচেয়ে বেশী সাহায্য করেছেন জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি রেনাটা লক ডেসালিয়ান। তিনিই জাতিসংঘের পক্ষে একটি আনুষ্ঠানিক ঘোষনা দিয়েছিলেন।সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘২২ জানুয়ারীর ঘোষিত নির্বাচনে সেনাবাহিনী সহায়তা দিলে আগামী দিনে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে আদৌ যোগ দিতে ও বেতন ভাতা কমাতে পারবে কিনা সেটি বিবেচনা করা হবে। অবশ্যি পরে এই ধমকা-ধমকি পরে ভূয়া বলে ধরা পড়েছে। জাতিসংঘ সদর দপ্তর থেকে যে বিবৃতি পাঠানো হয়েছিল সেখানে বাংলাদেশ সম্পর্কে উৎকন্ঠা ছিল, কিন্তু এ ধরনের কথা ছিল না। রেনেটা বিবৃতিতে নিজ দায়িত্বে এই কথাগুলো ঢুকিয়ে ছিলেন।’ (সূত্রঃ আমারদেশ, ১২ অক্টোবর, ২০০৮) ইকোনোমিস্টও লিখেছে, ‘বাংলাদেশের আবাসিক প্রতিনিধি যা করেছে জাতিসংঘের গত ষাট বছরের ইউএনের ইতিহাসে তা নেই। এই হুমকির পরেই জেনারেল মইন বাংলাদেশের রাস্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের অফিস বরাবর মার্চ করে ইমার্জেন্সী জারী, ইলেকশন বাতিল এবং মিলিটারী ব্যাকড্ কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠা করতে ‘আদেশ’ দেন। (ফেব্রুয়ারী ২১, ২০০৭)’


সেসময় বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব এবং পরবর্তীতে উপদেষ্টা মোখলেসুর রহমান চৌধুরীও এমনটি বলে প্রেসিডেন্টের নিকট মইনের ‘বিনয়াবনত হয়ে অনুরোধের’ দাবীকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রপতির ভাষণ, জরুরি অবস্থা জারির কাগজপত্র এবং প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগপত্র ইত্যাদি কাগজপত্র সেনাপ্রধান আগেই তৈরি করে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। রাষ্ট্রপতিকে জোর করে এসব কাগজপত্রে স্বাক্ষর করানো হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি এ বিষয়টি নিয়ে তার পত্নী ও আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন। আমাকে তিনি তাদের উপস্থিতিতে ডেকেছিলেন। কিন্তু আমাকে সেখানে যেতে দেয়া হয়নি। (আমাদের সময়, ফেব্রুয়ারী ২, ২০০৯)


সেসময়ে নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি, ওয়ান ইলেভেনের অন্যতম রূপকার ও বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাসুদউদ্দিন চৌধুরী পরোক্ষভাবে জেনারেল মইনকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘ওয়ান ইলেভেনের প্রেক্ষাপট নিয়ে আজ বিভিন্ন জন বিভিন্ন মত প্রকাশ করছেন। প্রত্যেকেই সেই ঐতিহাসিক ঘটনাকে নিজের মতো করে বলার চেষ্টা করছেন। আমি নিজেও ওয়ান ইলেভেনের ঘটনাবলির সঙ্গে জড়িত ছিলাম। ওইদিন অন্যদের সঙ্গে আমিও উপস্থিত ছিলাম বঙ্গভবনে। ১১ জানুয়ারি সারারাত বঙ্গভবনেই ছিলাম। আমি সকল ঘটনার সাক্ষী। তিনি বলেন, ইতিহাসই বিচার করবে ওয়ান ইলেভেনের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিল তারা নায়ক না খলনায়ক। আমরা কেন নিজেরা নিজেদের নায়ক বানাতে যাব? জেনারেল মাসুদ বলেন, ওয়ান ইলেভেন নিয়ে আমারও অনেক কিছু বলার আছে। অনেক অজানা তথ্য আমি জানি। একদিন সেসব অবশ্যই বলব। আজ দেখছি, অনেকেই সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে অনেক কথা বলছেন। এসবের জবাবও একদিন আমি দেব। এখন নয়। এখন আমি সরকারি কর্মচারী। এখন কিছু বললে নিজের অবস্থানের কথা মাথায় রেখে বলতে হবে। সব কিছু বলাও সম্ভব হবে না। ওয়ান ইলেভেনের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে ইতিহাসের কাছে আমি দায়বদ্ধ। সেই দায় আমাকে একদিন মেটাতেই হবে। (আমাদের সময়, ফেব্রুয়ারী৪, ২০০৯)’


মইনের উক্ত বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রধান অতিথি টিআইবি প্রধান অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ ‘১/১১-এ প্রেসিডেন্টের কাছে বিনয়াবনত হয়ে দেশের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেয়ার অনুরোধ জানান’-এর বিপরীতে সেনাপ্রধানকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনি যদি বাইরে কান পাতেন তাহলে মানুষের কাছে অন্য কাহিনী শুনতে পাবেন।’ উল্লেখ্য, উক্ত অনুষ্ঠানে জেনারেল মইন এমনসব বুদ্ধিজীবি ডেকে এনেছিলেন যাঁরা বাংলাদেশে শক্তিশালী সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয়তায় বাজেটে অতিরিক্ত বরাদ্ধ নিয়ে ফিবছর কথা বলে থাকেন। এমনকি ওই অনুষ্ঠানেও অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ বলেছেন, ‘জেনারেল মইন অন্যত্র স্বচ্ছতা আনার চেষ্টা করেছেন কিন্তু সেনাবাহিনীর (সশস্ত্রবাহিনী) কর্মের স্বচ্ছতা নেই (নয়াদিগন্ত জানুয়ারী৩০, ২০০৯)।’ অথচ প্রবীন এই অধ্যাপক ভাল করেই জানেন কোন দেশেরই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষাকারী বাহিনীর আভ্যন্তরীন কর্মকান্ড জনসমক্ষে উন্মোচন বা সরকার ছাড়া কাউকে স্বচ্ছতা প্রমাণ করতে দেয়ার সুযোগ নেই।মইন কিন্তু এর ন্যুনতম প্রতিবাদও করেননি।


প্রেসিডেন্টের ভাবার জন্য কিছু সময় চাওয়া নিয়ে মইন অন্যত্র লিখেছেন, ‘আমি জানতাম ইতোপূর্বে উপদেষ্টা পরিষদে অনেক ইতিবাচক সিদ্ধান্ত অজানা কারন ও প্রভাবে পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। যার কারনে আমরা কোনো দুষ্টচক্রকে আবার নতুন কোনো খেলা শুরু করার সুযোগ দিতে চাচ্ছিলাম না।’ ‘দুষ্টচক্র’ বলতে তিনি কাদের বুঝিয়েছেন তা সচেতন পাঠকদের বুঝতে আশা করি কষ্ট হবেনা। বর্তমান সরকারে অন্য জোট ক্ষমতায় থাকলে জেনারেল মইন এমন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান করতেন কিনা তা নিয়ে যেকোনো পাঠকই সন্দেহ করতে পারেন।কারন এক সময় সব জোটই সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরোধিতা করলেও বর্তমান পরিস্থিতি অনেকের জন্যই শাপে বর হয়েছে। বুদ্ধিজীবিদের সুরও পাল্টেছে, পত্র-পত্রিকাগুলোও হয়তো জরুরী অবস্থা নিয়ে আর মাথা ঘামাতে রাজী নয়। অথচ ২২শে অক্টোবর, ২০০৭ এ জেএফকে স্কুল অফ গভর্ণমেন্ট একই গোত্রীয়ভুক্ত বুদ্ধিজীবিরা প্রতিষ্ঠানটির ডীন ডঃ ডেভিড এলউড বরাবর ইমেইলে অনুরোধ জানিয়ে ইন্টারনেটে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানে নেমে পড়ে সেনাপ্রধাণকে এক অনুষ্ঠান থেকে দূরে রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন।


ওয়ান-ইলেভেনের এক বছরপূর্তি উপলক্ষ্যে ১১ জানুয়ারী ২০০৮-এ দৈনিক প্রথম আলো ‘বঙ্গভবনে সেই সময়ে যা ঘটেছিল’ শিরোনামে যা লিখেছে তার সাথে মইনের বর্ণনার মূল পার্থক্য তেমনটি নেই। মইন শুধু প্রেসিডেন্টের সাথে তাঁর আচরনগত ‘পার্থক্য’ দেখিয়েছেন যা বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের বুদ্ধিজীবিরাও বিশ্বাস করেননি।পাঠকেরা প্রথম আলোর ওই তারিখের আর্কাইভে গিয়ে দেখে নিতে পারেন।একটি পত্রিকা কি করে সেনাবাহিনী সংশ্লিষ্ট আভ্যন্তরীন ব্যাপারাদি এমন খুঁটিনাটিভাবে জানতে পারে তা ভাবতেই অবাক লাগে।একটা সময় ছিল যখন সেনাবাহিনী ও বিচারপতিদের নিয়ে লেখার আগে সাত-পাঁচ ভাবতে হতো, আজ উলটো সংশ্লিষ্ট বিভাগের স্বয়ং মহারথীরাই নয়-ছয় লিখে উদ্ভট জটলা সৃষ্টিতে সাহায্য করছেন।


একটি গল্প দিয়ে আজকের আলোচনা শেষ করতে চেয়েছিলাম।


২০০৯ সালের এক রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে পেনসেলভেনিয়া এভিনিউ ধরে একজন বৃদ্ধ লোক হোয়াইট হাউসের সামনে পাতা একটি বেঞ্চে এসে বসলেন।
প্রহরারত এক মেরিন গার্ডের কাছে জানতে চাইলেন, ‘আমি একটু ভিতরে যেতে চাই। প্রেসিডেন্ট বুশের সাথে দেখা করব।’
মেরিন ভ্রুঁকুঁচকে লোকটির দিকে তাকালেন। বিনয়ের সাথে বললেন, ‘স্যার, বুশ এখন আর প্রেসিডেন্ট নন এবং এখানে তিনি আর থাকেন না।’
লোকটি ‘ওকে’ বলে চলে গেলেন।
পরদিন লোকটি আবারো হোয়াইট হাউসে এসে মেরিন গার্ডকে একইভাবে ভিতরে ঢুকে প্রেসিডেন্ট বুশের সাথে দেখা করার আগ্রহ ব্যক্ত করলেন।
মেরিন উত্তরে বললেন, ‘স্যার, গতকাল আপনাকে যা জবাব দিয়েছি আজো তাই দিচ্ছি। বুশ ইজ নো লংগার প্রেসিডেন্ট এন্ড নো লংগার রিসাইড হিয়ার।’
লোকটি এবারো আগের মত মেরিনকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিলেন।
তৃতীয় দিনেও ব্যক্তিটি আগের মতই হোয়াইট হাউসে এসে ওই মেরিনকেই বললেন, ‘আই উড লাইক টু গো ইন এন্ড মিট উইথ প্রেসিডেন্ট বুশ (I would like to go in and meet with president Bush)।’ সংগতকারনেই মেরিন আর রাগ থামাতে পারলেন না। অগ্নিমূর্তি ধারন করে লোকটির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘স্যার, আজ দিয়ে তিনদিন আপনি একাধারে মিঃ বুশের সাথে কথা বলতে চাচ্ছেন। আর আমি আপনাকে বারে বারে একই কথা বলে যাচ্ছি মিঃ বুশ ইজ নো লংগার প্রেসিডেন্ট এন্ড নো লংগার রিসাইড হিয়ার। আপনি কি আমার কথা বুঝতে পারছেন?’
বৃদ্ধ লোকটি এবার সহজভাবে মেরিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওহ্, আই আন্ডারস্ট্যান্ড। বুশ যে ‘নো লংগার আওয়ার প্রেসিডেন্ট’ কথাটি আমার ভারী পছন্দের। আই জাস্ট লাভ হিয়্যারিং ইট।’
মেরিনগার্ড মূহুর্তেই লোকটির দিকে আকর্ষন বাড়িয়ে একটি স্যালুট দিয়ে বললেন, ‘সি ইউ টুমোরো ,স্যার।’

২০১০ সালের কোনো একদিন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হেড কোয়ার্টারে সামনে কোনো এক বাংলাদেশীর এমন প্রশ্নের জবাবে হয়তো তখনকার সেনাপ্রধান গার্ড লোকটিকে স্যালুট দিয়ে বলবে ‘সি ইউ টুমোরো স্যার’।

Friday, November 7, 2008

ওবামা কি সত্যি পারবেন পৃথিবীটাকে ‘চেঞ্জ’ করে ফেলতে?

ইলেকশনের একদিন আগে ওবামার ‘দিস ইজ এ ডিফাইনিং মোমেন্ট ইন আওয়ার হিস্ট্রি (This is a defining moment in our history)’ নামক একটি আর্টিকেল ‘দ্যা ওয়াল স্ট্রিট জার্ণাল’ প্রকাশ করে।এতে তিনি লিখেছেন, ‘কাল থেকে আমাদের জাতির জন্য আমি আপনাদেরকে নতুন করে একটা মহান ইতিহাস লেখার আহ্‌বান জানাই। যদি আপনারা আমাকে ভোট দেন, তাহলে আমরা নিছক একটা নির্বাচনেই জিতব না, সবাই মিলে দেশটাকে, এমনকি পুরো দুনিয়াটাকেই বদলিয়ে দিব (Tomorrow, I ask you to write our nation's next great chapter... If you give me your vote, we won't just win this election -- together, we will change this country and change the world)।’ তিনি ম্যাককেইনের চরম নোংরা আক্রমণের জবাব এক সপ্তাহ আগে এভাবে দিয়েছিলেন, ‘আমি আরো এক সপ্তাহ রিপাবলিকানদের বাজে কথা শুনতে প্রস্তুত, কিন্ত আমেরিকানরা আরো চার বছর ম্যাককেইনের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে বুশের বস্তাপচা নীতি টানতে আর প্রস্তুত নয়।’

সবাই মোটামুটি আশা করছেন, ওবামা তাঁর স্ব-জাতির এই ক্রান্তিকালে কিছুটা হলেও পরিবর্তন আনতে পারেন অথবা ভিন্নভাবে বললে বলতে হবে, পরিবর্তন তাঁকে আনতে হবেই। কিন্তু ওয়াশিংটনের ওভাল অফিসে বসে পেন্টাগনের আগ্রাসী ভূমিকা থেকে হাত গুটিয়ে পুরো পৃথিবীটাকে আফ্রিকান-আমেরিকান ব্যারাক ওবামা কিভাবে বদলাতে পারবেন সেইটার এখন দেখার বিষয়।

বুশের বিদায় ঘন্টা উৎসবের প্রস্তুতি অনেক আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল আমেরিকানদের মধ্যে। একাধিক কুটির শিল্প বিভিন্ন চমৎকৃত দ্রব্যাদি যেমন, ক্যালেন্ডার, ম্যাগ্নেট, টি-শার্ট ইত্যাদি নিয়ে আগ্রহভরে প্রস্তুত হয়েছিল বুশ আমলের দ্রুত সমাপ্তির এই প্রতীক্ষিত মূহুর্তের আশায়। কিন্তু প্রতীক্ষিত দিনটি যখন এসেই যাবে অর্থাত বুশ ওভাল অফিস ছেড়েই যাবেন অথবা সবচেয়ে ব্যয়বহুল চাকরিটি যখন ওবামা করা শুরু করবেন, তখন তিনি বুঝবেন বুশ তার উত্তরাধিকার রত্নের জন্য এমন এক উইল রেখে গিয়েছেন যা বাস্তবায়ন করতে গেলে পৃথিবীর নাড়ি-ভুড়ি সব ছিঁড়ে খেতে হবে।

মে ৩১, ২০০৮ এ সাউথ এশিয়া টাইমস্‌ ‘ওয়ার্ল্ড পলিসি ইন্সটিউটের আর্মস ট্রেড রিসোর্স সেন্টার’-এর সিনিয়র রিসার্চ এসোসিয়েট ফ্রিডা বেরিগ্যান (Frida Berrigan) এর একটি বিশাল গবেষণালব্ধ প্রবন্ধ ‘পেন্টাগন কিভাবে দুনিয়াটাকে সাজাচ্ছে (How the Pentagon Shapes the world)’ প্রকাশ করেছে। আজকের নিবন্ধে আমরা উক্ত আর্টিকেলের বিভিন্ন দিক নিয়ে সংক্ষিপ্তভাবে আলোকপাত করব। প্রবন্ধে বলা হয়েছে, ১৯ জানুয়ারী ২০০৯ এ যেই প্রেসিডেন্টের আসনে বসুন, তিনি আর পেন্টাগনকে পঞ্চভূজ দালান হিসেবে বিবেচনা করতে পারবেন না। আমেরিকান সেনাবাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ‘কোল্ড ওয়্যার’ শেষে যেভাবে দুনিয়াটাকে ‘ইউনিপোলার ওয়ার্ল্ড’ বানিয়েছে তা থেকে তিনি নিজেকে দূরে রাখতে পারবেন না। অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপাত্য, শান্তি শান্তি বলে বিভক্তির বীজ বোনা, হাতেম তাঈ-র মত দয়ালু সেজে দেশে দেশে নাক গলানো, মিলিটারীকে এমন উচ্চ প্রযুক্তিতে রূপান্তরিত করা যে এর সমকক্ষ দুনিয়াতে যাতে আর কেউ না থাকে। সরকারী কর্মকর্তারা ২০০১-এর সেপ্টেম্বরের একেবারে শুরুতে বুশ প্রশাসনের আরো ৬০ টি জাতির উপর টার্গেট নেয়ার ফুটপ্রিন্টও প্রকাশ করে ফেলেছিল। উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা পেন্টাগণকে এমনভাবে প্রস্তুত করেছেন যেন, আমেরিকার সেনাবাহিনী পৃথিবীর যেকোন প্রান্তেই সংশ্লিষ্ট দেশ বা আন্তর্জাতিক আইন কানুনের তোয়াক্কা না করে সম্পূর্ণ ‘যৌক্তিক’ ভাবেই আঘাত হানতে পারে। ২০০২ সালে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডোনাল্ড রামসফেল্ড প্রতিরক্ষা কৌশলের ক্লাসিক শর্টহ্যান্ড ১-৪-২-১ প্রকাশ করেন। এর ব্যাখ্যা এরূপ, আমেরিকা তার নাগরিকদের রক্ষার কথা বলে প্রথমেই চারটি সংবেদনশীল অঞ্চল (ইউরোপ, উত্তর-পূর্ব এশিয়া, পূর্ব এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্য)-এ আগ্রাসন চালাবে। এদের মধ্যে দুই অঞ্চলকে এক সাথে পরাস্ত করতে সক্ষম এবং অন্য আরেকটি অঞ্চলে সময়ের ব্যবধানে এমনিতেই পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিজিত হয়ে যাবে।

১) পেন্টাগণের আকাশচুম্বী বাজেটঃ
বুশ প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসেই এই বিভাগে বাজেট দ্বিগুণ করে ৩০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করে ফেলেন। ২০০৯ অর্থবছরে শুধুমাত্র নিয়মিত বাজেট বেড়ে দাঁড়াবে এরও প্রায় দ্বিগুণ (৫৪১ বিলিয়ন ডলার)। কারণ তহবিল সরবরাহ করতে হবে ‘যুদ্ধব্যয়ে (war spending)’ ও ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ (war on terror)’-সহ নিজেদের অতিরিক্ত প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থার জন্য। ফেব্রুয়ারি ২০০৮ পর্যন্ত কংগ্রেসের বাজেট অফিসের সূত্র ধরে বলা হয়েছে, আইন প্রণেতারা ৭৫২ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্ধ করেছেন আফগানিস্তান, ইরাকসহ অন্যান্য স্থানে চলমান যুদ্ধ খরচের জন্য। ২০০৯ অর্থবছরের জন্য যে আরো ১৭০ বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন পড়বে তাও পেন্টাগণ আগেভাগে বলে রেখেছে। অর্থাৎ সামনের বছরে ডলারের পরিমান আর বিলিয়নে থাকবে না চলে যাবে ট্রিলিয়নের ঘরে। নিউইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট বব হারবার্ট (Bob Herbert) লিখেছেন, একশো ডলারের নোট যদি একত্রে সাজানো হয় ছয় ইঞ্চি উঁচু বানাতে এক বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন পড়বে। এক বিলিয়ন ডলার ওইভাবে স্তরে স্তরে সাজালে এর উচ্চতা হবে ঠিক ওয়াশিংটনের দূর্গ পর্যন্ত, আর এক ট্রিলিয়ন ডলারের উচ্চতা হবে ১৬০ কিমি যা কিনা আফগানিস্তানের সর্বোচ্চ শৃংগ হিন্দু কুশের চেয়েও বিশ গুণ বেশী উঁচু।
ফেডারেল গভর্ণমেন্টের এই ‘বিবেচনামূলক প্রোগ্রাম (discretionary program)’-এর জন্য শুধুমাত্র সামরিক খাতেই সমগ্র বাজেটের প্রতি ডলারের ৫৮ সেন্টই ব্যয় হচ্ছে। অর্থাৎ পেন্টাগণের সর্বমোট বাজেট আমেরিকার শিক্ষা, পরিবেশ রক্ষা, বিচার বিভাগ, সাবেক সৈন্যদের সুযোগ সুবিধা, আবাসন সহযোগিতা, যোগাযোগ, কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ, কৃষি, জ্বালানী এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রকল্পখাতসমূহ মিলে সর্বমোট বরাদ্ধেরও বেশী।

২) কূটনৈতিকের ভূমিকায় পেন্টাগণঃ
আঠার শতক থেকে আমেরিকান রাস্ট্রদূতেরা সেদেশের প্রেসিডেন্টেরই প্রতিনিধিত্বই করতেন। তারা আমেরিকার পররাস্ট্রনীতি সংশ্লিষ্ট দেশসমূহ মানছে কিনা তা নিশ্চিত করত অথবা সেসব দেশকে মেনে চলতে বুঝাতো। একজন রাস্ট্রদূত তাদের কাজের ধরণ এভাবে বুঝিয়েছিলেনঃ “The rule is: if you’re in Country, you work for the ambassador. If you don’t work for the ambassador, you don’t get country’s clearance” কিন্তু দিন পাল্টেছে। বুশীয় আমলে পেন্টাগণ এই মডেলটি উল্টিয়ে দিয়েছে। সিনেটর রিচার্ড লুগার (Richard Lugar) এর ২০০৬ সালের কংগ্রেসের রিপোর্ট অনুযায়ী, রাস্ট্রদূতেরা এখন অনুভব করেন তাদেরকে মিলিটারী অফিসারদের অনুগত হতে হবে। সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় তারা নিজেদেরকে দুই নম্বর টীম মনে করেন।

নতুন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রবার্ট গেটস (Robert Gates) -ও এই সমস্যা সম্পর্কে অনবহিত নন। তিনি এর জন্য সামনের বছরে অতিরিক্ত আরো অর্থ বরাদ্ধের আহবান জানিয়ে বলেছেন, আমাদের মাত্র ৬৬০০ ফরেন সার্ভিস কর্মকর্তা রয়েছে, যার জন্যই মূলতঃ সেনাদের সাহায্য নিতে হচ্ছে। এ সংখ্যা বাড়াতে আরো টাকার প্রয়োজন। এই প্রেক্ষিতে একজন রাস্ট্রদূত ক্ষোভের সাথে বলেছেন, ওই অতিরিক্ত অর্থও সামরিক খাতেই ব্যয়িত হবে।

কূটনৈতিক চাল দিতে গিয়ে আমেরিকান রাস্ট্রদূতেরা যে শব্দসমূহ ব্যবহার করেন তাহলো, ইন্টারএজেন্সি, কো-অপারেশন, সিকিউরিটি প্রবলেম, রিজিওনাল প্রবলেম ইত্যাদি। নাইন ইলেভেনের পর সংশ্লিষ্ট দেশসমূহ মেনে না চললে, ‘সহযোগিতা (co-operation)’এর সংজ্ঞা পালটে ‘হুমকি (Threat)’-তে রূপ নেয়।

৩) অস্ত্রডিলারের ভূমিকায় পেন্টাগণঃ
আমেরিকার গোয়েন্দা বিভাগ সম্মন্ধে মানুষের ধারণা একেবারেই ধোঁয়াটে। এর জন্য বরাদ্ধ হয় ‘কালো টাকা (Black Budget)’। গোয়েন্দা বিশারদরা বলেছেন, এই এক দশক আগেও এর পরিমাণ ছিল ২৬ বিলিয়নে। ৯/১১এর পর (২০০৩ সালে) তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ বিলিয়ন ডলারে। ‘স্পাইস্‌ ফর হায়ার (Spies for Hire)’ গ্রন্থের লেখক অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিক টিম শোরোক (Tim Shorrok) এর মতানুযায়ী, পেন্টাগণ বর্তমানে ইউএস ইন্টেলিজিন্সের আশি ভাগই নিয়ন্ত্রণ করছে যার পরিমাণ গত বছরে ছিল ৬০ বিলিয়ন ডলার। প্রাক্তণ সিআইএর কর্মকর্তা ‘সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসি’-র বিশেষজ্ঞ মেল গূডম্যান (Mel Goodman) এর দৃষ্টিতেঃ The Pentagon has been the big bureaucratic winner in all of this”

২০০৬ সালে আমেরিকা একাই অস্ত্র বেচেছে সারা পৃথিবীর অর্ধেক (১৪ বিলিয়ন ডলার) পরিমান। এর মধ্যে পাঁচ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে পাকিস্তানের কাছ থেকে এফ-১৬ এর জন্য এবং সৌদী আরবের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পূনর্বিন্যাসের জন্য চুক্তি হয়েছে ৫.৮ বিলিয়ন ডলারের। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে রাশিয়া (৫.৮ বিলিয়ন ডলার), ৩য় অবস্থানে বৃটেন (৩.৩ বিলিয়ন ডলার)। মজার ব্যাপার হল, ৭০ ভাগেরও বেশী অস্ত্র বিক্রি হয়েছে উন্নয়নশীল দেশসমূহ যারাই মূলতঃ আমেরিকার ওয়ার্ল্ড পার্টনারের গিনিপিগ।

৪) গ্লোবাল ভাইসরয় এবং ‘স্বর্গ নিয়ন্ত্রণকারী দেবতার’ ভূমিকায় পেন্টাগনঃ
বুশামলে পেন্টাগন ভাইসরয়সূল্ভ সামরিক প্রত্যাদেশের মাধ্যমে বিশ্ব সমাজকে সুস্পষ্টভাবে বিভক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। সত্যি বলতে কি, ৯/১১-এর আগ পর্যন্ত আফ্রিকা মহাদেশ ছাড়া পৃথিবীর এমন কোন দেশ ছিল না, যেখানে আমেরিকা সেনাবাহিনীর প্রভাব কোন না কোনভাবে পড়েনি। এ বছর ‘ইউএস আফ্রিকা কমান্ড (আফ্রিকম-Africom)’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানচিত্রের সেই শূন্যতাও পূরণ করা হল। মিসর বাদে এ অঞ্চলের সব দেশকে এই কমান্ডের অধীনে নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে। মিসরকে বিশেষভাবে রাখা হয়েছে ইউএস সেন্ট্রাল কমান্ডের অধীনে। নব্য ঔপনিবেশকতা বিস্তৃত করার এই ধারাকে বুশ এভাবে ব্যাখ্যা করেছেনঃ “enhance our efforts to bring peace and security to the People of Africa and promote our common goals of development, health, education, democracy and economic growth in Africa”.

আফ্রিকান এফেয়ার্সের সহকারী প্রতিরক্ষা সেক্রেটারী তেরেসা উইল্যান (Theresa Whelan) মন্তব্য করেছেন, It is about increasing the global reach of the Pentagon.

ভূ-পৃষ্ঠের উপরিভাগ দখলই যথেষ্ঠ নয়, চাই নভোমন্ডলও। মনে হয় কিছু স্বর্গের নিয়ন্ত্রনও পেন্টাগন চাইছে। জাতীয় মহাকাশ নীতি (National Space Policy) ‘ইউএস স্পেস কমান্ড ভিশন ২০২০’ প্রকাশ করে বুশ প্রশাসন বলেছে, আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও তাদের অধিকার রয়েছে ‘মহাকাশ প্রতিরোধের’ অর্থাৎ মহাকাশে বাঁধা-বন্ধনহীনভাবে তারা যা চাইবে তাই প্রতিস্থাপন করতে পারবে। সেই সাথে থাকবে প্রতিরক্ষার দায়িত্বও তাদের উপরই।

সম্প্রতি আরো খবর বেরিয়েছে ইউরোপ, দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া ও আফ্রিকায় ‘ভালো সাফল্য’ অর্জনের পর মার্কিন ন্যাশনাল গার্ডের স্টেট পার্টনারশিপ প্রোগ্রাম (এসপিপি) এখন সম্প্রসারিত হচ্ছে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। হনহুহু থেকে মার্কিন ন্যাশনাল গার্ড ব্যুরোর একজন স্টাফ সার্জেন্টের প্রণীত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমেরিকার কোনো অঙ্গরাজ্যের পার্টনার হওয়ার জন্য বাংলাদেশের অনুরোধটি অনুমোদন করেছেন ইউএস প্যাসিফিক কমান্ডের অধিনায়ক অ্যাডমিরাল টিমোসি কিটিং। তিনি বাংলাদেশের পার্টনার হিসেবে আমেরিকার কোনো একটি অঙ্গরাজ্য খুঁজে দেয়ার জন্য ন্যাশনাল গার্ড প্রধান লে. জেনারেল স্টিভেন ব্লামকে দায়িত্ব দিয়েছেন। এ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হলে বাংলাদেশ হবে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যগুলোর সাথে জোটবাঁধা ৫৯তম রাষ্ট্র। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের এই স্টেট পার্টনারশিপ প্রোগ্রাম চালু করা হয় ১৯৯৩ সালে-সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে সদ্য স্বাধীন দেশগুলোকে ন্যাটো আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য বানানোর আশা দিয়ে আমেরিকার বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের পার্টনার করা হয় তাদেরকে। পরে দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকা হয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এই পার্টনারশিপের জাল। (সূত্রঃ নয়াদিগন্ত ৩ নভেম্বর, ২০০৮)
উপরোক্ত পর্যালোচনার প্রেক্ষিতে উপসংহারে বলা যায়, বুশ সরকারের আট বছরের এতসব কূটকৌশল ও অশুভ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রভাব সামনের সব বাজেটেই পড়বে। সরকারে যেই আসুক না কেন পেন্টাগনের এই রাক্ষুসী ভূমিকা থেকে কেউই বিচ্ছিন্ন থাকতে পারবে না। ফলত. নানান ভিশন দাঁড় করিয়ে আমেরিকার নাগরিকদের ট্যাক্স গুণতে হবে চক্রবৃদ্ধি হারে। যেমন হতে পারে, কমপ্লেক্স ২০৩০ ভিশন, ইউএভি রোডম্যাপ ২০৩০, আর্মির ভবিষ্যত যুদ্ধ পন্থা, যোগাযোগ বিভাগের ভিশন ২০৫০, পরিবেশ সুরক্ষা ভিশন ২০৫০ ইত্যাদি যার তালিকা কখনো শেষ হবার নয়। আর এই ব্যয়বহুল খরচের মাশুল দিতে হবে অন্ততঃ তৃতীয় বিশ্বকে অস্ত্র বিক্রি, তেল কব্জা, মানুষহত্যাসহ অজস্র কূটচক্রান্তের মাধ্যমে।

Thursday, October 23, 2008

কুশিক্ষা যখন উচ্চশিক্ষার পথ রুদ্ধ করে


খুব পুরোনো একটা প্রবাদবাক্য নিয়ে আমার মতো সবাই বোধ করি স্কুল জীবনে ভাব-সম্প্রসারণ লিখতেন,‘দূর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য, সর্পের মস্তকে মণি থাকলেও সে কি ভয়ংকর নহে?’এরসাথে আরো একটি যোগ না করে পারছিনা ‘গুরুজনে করো নতি, সেবা করো কায়মনে।’এই লেখাটি শুরুর দিন (অক্টোবর ২২, ২০০৮) দৈনিক কাগজে আসা দুইটি খবর উপরোক্ত দুইটা প্রবাদ বাক্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিল। জাহাংগীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে তাঁরই বিভাগের ছাত্র/ছাত্রীরা নৈতিক স্খলনজনিত কারনে জুতা-পেটা করছেন, আরেকটি হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি তাঁর বাসভবনে সর্বশেষ হামলাকারী তাঁরই প্রিয় (!) ছাত্রদের জরুরী আইনে দ্রুত গ্রেফতার করানোর জন্য পুলিশের আইজিপি থেকে শুরু করে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় পর্যন্ত হন্তদন্ত হয়ে তদবির করছেন।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, গুরুজনদের উপর হামলা আমরা এর আগে অনেক দেখেছি।এমনকি আহত ছাত্রদের দেখতে এসেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ভিসিকে নিক্ষিপ্ত বালিশ, থুথু, অকথ্য গালিগালাজ ইত্যাদি মোকাবেলা করতে হয়েছে।নিঃসন্দেহে এসব খারাপ কাজ, এর কঠোর বিচার হওয়া উচিৎ। কিন্তু এর সাথে আরো একটা বিষয় এড়ানো উচিৎ হবেনা, তাহলো কিছু কিছু শিক্ষকদের প্রতি ছাত্রদের এত ঘৃণাই বা কেন?যে ছাত্ররা আজো কম শিক্ষিত প্রাইমারী স্কুলের কোনো শিক্ষককে দেখলে অতি আদবে চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারেনা, সেই একই ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচচ ডিগ্রীধারী পন্ডিতদের দিকে কেন ধেয়ে আসে? এর জন্য শুধু কি ছাত্রদেরই দোষ দিব নাকি দূর্জন বিদ্বানদের ফ্যাসিস্ট কার্যকলাপও এসব চাপা ক্ষোভ বিস্ফোরণের একটি অন্যতম কারণ?

নীল, সাদা, হলুদ ইত্যাদি রঙে রঞ্জিত হয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক ছদ্মাবরনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা নিজেরাই নিজেদেরকে বিভক্ত করে রেখেছেন যা দুনিয়ার অন্য কোন দেশের শিক্ষকেরা শুনলে শুধু অবাকই হন না, উলটো প্রশ্ন করে বসেন, ‘এও আবার কি করে সম্ভব?’ নিষিদ্ধ না থাকা যেকোন রাজনৈতিক দলের সদস্য যে কেউই হতে পারেন, প্রচারও করতে পারেন তার নিজস্ব মতাদর্শ-এটা তার নাগরিক অধিকার। এসব কোনটাই দোষের নয়, কিন্তু সমস্যা হল যখন কিনা কেউ নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে বসে তার বেড়ে উঠা অতীতের গন্ডি ও বিশ্বাসের বাইরে আসতে পারেন না।বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারকে যদি আমি আমার প্রিয় রাজনৈতিক দলের সদর দপ্তরটি বানিয়ে ফেলি তখনই সমস্যা দেখা দেয়।সেক্ষেত্রে আমি তো আমার পদের সম্মান রাখতে পারলাম না। তবে হ্যাঁ, মিডিয়া হাতে থাকলে অনেক কিছুই সম্ভব! ঘোড়াকে যেমন আকাশে উড়ানো যায়, আবার ঈগলকেও পানিতে ডুবানো যায়।যাঁরা নিজেদেরকে বিশ্বজনীন মানবতাবাদী বলে সারাক্ষন মুখে ফেনা তোলেন, তাঁরা নিজেরা বোঝেনও না যে বিপরীতাদর্শের প্রতি তাঁদের একপেশে ফ্যাসিস্ট মনোভাবের কারনেই মানবতা সবচেয়ে বেশী ভুলন্ঠিত হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচচশিক্ষা নিতে সম্পূর্ন অযৌক্তিকভাবে মাদ্রাসা ছাত্রদেরকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। গোটা ভর্তি পদ্ধতিই যেখানে নতুন করে সাজানোর কথা শিক্ষাবিদরা বলছেন, সেখানে কি করে ভর্তি পরীক্ষার কিছুদিন আগে উচচমাধ্যমিক স্তরে বাংলা ও ইংরেজী বিষয়ে ২০০ নাম্বার করে থাকতে হবে বলে কিছু বিভাগ যোগ্যতা নির্ধারণের একটি মাপকাঠি বানায়? ছাত্রদের বৃহৎ একটি অংশের উপর কলা ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদের যেসব বিভাগসমূহ এই অবিচার করছে বা করতে যাচ্ছে সেগুলোর নাম পত্রিকায় এসেছে বাংলা, ইংরেজী, লিংগুয়েস্টিক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, অর্থনীতি, লোক প্রশাসন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং উইমেন এ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ। পাঠকেরা নিশ্চয়ই জানেন, যারা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশোনা করে ‘ও’ বা ‘এ’ লেভেলে ডিগ্রী নেয় তারাও বাংলা বা ইংরেজী বিষয়ে ২০০ নাম্বারের পরীক্ষা দেয় না।একই কায়দায় এসব ছাত্রদের উপর আপত্তিকর ওইসব শর্তসমূহ আরোপ না করায় ‘ক’ ও ‘ঘ’ ইউনিটের দায়ী ব্যক্তিদের কেউ যদি ‘দূর্জন বিদ্বান’ বলে গালমন্দ করে প্রতিরোধ করতে আসে তাদেরকে কে ঠেকাবে?

‘সব ছাত্রদের সমানভাবে দেখা উচিৎ’ এটা সম্মানিত শিক্ষক মহোদয়রা হরহামেশা বললেও অনেকের কার্যকলাপ ঠিক এর উল্টো। সর্বোচচ বিদ্যাপীঠে এমন শিক্ষকেরও প্রমাণ মিলে যাঁরা তাঁর একাংশ ছাত্রদের বিরুদ্ধে বখে যাওয়া আদু ভাই, ধাড়ি ছাত্রনেতাদের চেয়েও বেশী কথা বলেন।একটি নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশের মানুষ যখন অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন ঠিক সেই সময়ে নন-ইস্যুকে ইস্যু বানানোর মতলব, আর যাই হোক, নিশ্চয়ই ভাল বলা যাবেনা। তাছাড়া বাংলাদেশ সরকার অনূমোদিত যেকোন পদ্ধতিকে অস্বীকার করাতো আইন অমান্যেরই শামিল।ভর্তি পরীক্ষা যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ নির্ধারনের মাপকাঠি হয় তবে ঢাকা ভার্সিটির উচিৎ বুয়েটের অবিতর্কিত পদ্ধতি সম্মন্ধে জ্ঞানলাভ করা। বিআইটি বা বর্তমানে অন্যান্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় সমূহও মোটামুটি একই নিয়ম কঠোরভাবে অনুসরন করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে।দেশের সব ছাত্রদেরকে সমানভাবে মূল্যায়ন করায় এনিয়ে আজো তাঁদের বিরুদ্ধে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেনি। তাছাড়া কোন কোন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রদের ব্যক্তিগত রুঢ আচরনের অভিযোগ থাকলেও বুয়েটের শিক্ষকেরা কোন সময়েই নিজেদেরকে লাল, সাদা, কালো, নীল, হলুদ ইত্যাদি আবরনে বৃত্তাবদ্ধ করে রাখেন নি।বলা বাহুল্য, এজন্যই বোধ হয় তাঁদেরকে কখনো নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য কোথাও দৌড়াতেও হয়নি।

কমিউনিজম ও একনায়কতান্ত্রিক দেশ ব্যতিরিকে যেকোন দেশেই শিক্ষাব্যবস্থার একাধিক মডেল বিদ্যমান। বহুমাত্রিক সংস্কৃতি ও বিশ্বাসকে দমন নয়, বরঞ্চ উৎসাহিত করাই হল গনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার স্বীকৃত একটি মৌলিক উপাদান। নিজস্ব কালচারকে টিকিয়ে রাখতে জাতিসংঘের মত প্রতিষ্ঠানও বিভিন্ন কমিউনিটিতে নিরন্তরভাবে প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে । তাদের জনপ্রিয় একটি শ্লোগান হল, ‘Celebrate your own festival (নিজের উৎসব নিয়ে আনন্দ করো)’। আমেরিকা ও কানাডাতে ক্যাথলিক স্কুল, জুইশ স্কুল, ফ্রেঞ্চ স্কুল, ইসলামিক স্কুল এমনকি তামিল স্কুলও দেখেছি। সেসব স্কুল থেকে পাশ করা গ্রাজুয়েটদের শর্তের মারপ্যাঁচ দিয়ে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ই এমন কোন হিংসাত্মক সিদ্ধান্ত নেয়না। আমেরিকার যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি মাস্টার্স করেছি, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম থেকে শুরু করে এর উদ্ধেশ্য পর্যন্ত প্রসপেক্টাসে স্পষ্টভাবে বিধৃত করা হয়েছে খ্রীস্টান আদর্শ প্রচারের মহৎ ব্রতের কথা।এমনকি প্রতিটি ক্লাসে ক্রুশবিদ্ধ যীশুর প্রতিকৃতি শোভা পেলেও কর্তৃপক্ষ কিছু মুসলিম ছাত্র/ছাত্রীদের জন্য সুন্দর একটি মসজিদের ব্যবস্থা করতে ভোলেননি।মাল্টি কালচারিজম উৎসাহিত করতে কানাডায় বছরে একটি দিনকে ‘ইন্টারন্যাশনাল ভিলেজ ফেস্টিভ্যাল’ বলেও অভিহিত করা হয়।

বাংলাদেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস অথবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল উদ্ধেশ্যের দিকে না তাকিয়ে আমরা উক্ত বিভাগসমূহের সম্মানিত শিক্ষকদের মোটিভের দিকে তাকাতে পারি।ধরে নিলাম, তাঁরা তাঁদের বিভাগসমূহকে আরো আধুনিকীকরন করতে চাচ্ছেন। তার মানেটা কি? সেটি তো হওয়া উচিৎ ছিল পদ্ধতি আরো সহজ করে বেশী ছাত্রদেরকে কাছে টেনে নিয়ে আসা।কথা ছিল, সনাতনী গৎবাঁধা শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে ব্যবহারিক উন্নত শিক্ষায় ছাত্রদেরকে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করা।পক্ষে কোন্‌‌ দেশের উদাহরন তাঁরা টানতে চাচ্ছেন?সেসব দেশের মধ্যে বর্তমানে একমাত্র চীন ছাড়া তো হারাধনের অবশিষ্ট আর কেউ নেই। সবাই আজ বাস্তবতা স্বীকার করে ভিন্ন পদ্ধতির সৌন্দর্য্য শিখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ সেন্টারে রাতদিন খাটছেন।আর আমাদের দেশে চলছে এর উল্টোটা! কি বিচিত্র পৃথিবী!

এবার দেখি, বাংলাদেশের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইন মানুষের এই মৌলিক অধিকারটি নিয়ে কি বলে। বাংলাদেশের সংবিধানে উল্লেখ রয়েছেঃ
‘২৮(১) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না। (৩) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোন বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোন নাগরিককে কোনরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না। ২৯(১) প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে। (২) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না।’
আর জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদ বা ‘দ্যা ইউনিভার্স্যাল ডিক্ল্যারেশন অব হিউম্যান রাইটস’-র ২৬ নং অনুচ্ছেদে ১ থেকে ৩ নং ধারায় এভাবে বলা হয়েছেঃ
Everyone has the right to education. Education shall be free, at least in the elementary and fundamental stages. Elementary education shall be compulsory. Technical and professional education shall be made generally available and higher education shall be equally accessible to all on the basis of merit. (অর্থাৎ, লেখাপড়া শেখা প্রত্যকেরই অধিকার।এটা হতে হবে বিনা পয়সায়, অন্ততপক্ষে প্রাইমারী শিক্ষাসমূহ। টেকনিক্যাল এবং পেশাগত শিক্ষা অবশ্যই সর্বসাধারনের জন্য উন্মুক্ত হতে হবে।আর উচচশিক্ষার দুয়ার সবার জন্য সমানভাবে মেধার ভিত্তিতেই নির্ণিত হবে।)
Education shall be directed to the full development of the human personality and to the strengthening of respect for human rights and fundamental freedoms. It shall promote understanding, tolerance and friendship among all nations, racial or religious groups, and shall further the activities of the United Nations for the maintenance of peace. (অর্থাৎ, শিক্ষা মানুষের ব্যক্তিত্ত্ব উন্নত করনের নির্দেশনা দিবে এবং সম্মানের ভিত্তিতে মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা মজবুত করবে।প্রত্যকে দেশ, জাতি বা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষা পারস্পরিক বোঝাপোড়া, সহমর্মিতা এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে উৎসাহ যোগাবে। জাতিসংঘের শান্তি বজায় রাখা কর্মসূচীতেও এটা উৎসাহ যোগাবে।)
Parents have a prior right to choose the kind of education that shall be given to their children. (অর্থাৎ, ছেলেমেয়েদের যেকোন ধরনের শিক্ষা প্রদানের অধিকার পিতা-মাতাদের রয়েছে।)

পরিশেষে বলব, প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে এমন মানুষ নিশ্চয়ই লুক্কায়িত আছে, যারা চায় না বাংলাদেশের মানুষ শিক্ষা-দীক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে যাক। সারা দেশের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন স্পর্শকাতর বিষয়সমূহ উস্কে দিয়ে হিংসা, হানাহানি ছড়িয়ে এরা হয়তো ছাত্রদেরকে সারাক্ষন ব্যস্ত রাখতে চায়। আর যেকোন অন্যায়, জুলুমের পরিনতি যে কখনো ভাল ফল বয়ে আনেনা পাকিস্তানের স্বৈরশাসক মোশাররফের সাম্প্রতিক মাদ্রাসাবিরোধী জংগীদমন অভিযান তার বড় প্রমান। একই প্রক্রিয়ায় লালন-ভাস্কর্য, মাদ্রাসা ছাত্ররোধ ভর্তি ইত্যাদি ইস্যু সুপরিকল্পিতভাবে তৈরী করে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে ক্ষেপিয়ে দিয়ে গ্লোবাল ষড়যন্ত্রকারীরা আন্তর্জাতিক অংগনে বাংলাদেশকে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-র অংশীদার ও জংগী দেশ বানাতে মরিয়া হয়ে উঠছে। মাননীয় ভিসি ডঃ ফায়েজ যেমন তাঁর বাসা আক্রমনকারী দুস্কৃতকারীদেরকে আচ্ছামত শাস্তি দেওয়ানোর জন্য অস্থির হয়েছেন, ঠিক তেমনি তাঁর আরো দ্বিগুন-তিনগুন অস্থির হওয়া উচিৎ যেন একদল ছাত্র/ছাত্রীর মহামুল্যবান জীবন ও গোটা দেশ নিয়ে কেউ ছিনিমিনি না খেলে। ব্যক্তিগতভাবে আমার সারা গোষ্ঠীর কেউ-ই মাদ্রাসায় লেখাপড়া না করলেও এই অবিচারের বিরুদ্ধে যেমন কলম ধরে প্রতিবাদ জানাতে বাধ্য হচ্ছি, আর যাঁরা এর ভুক্তভোগী তাদের মনোবেদনা আঁচ করতে সংশ্লিষ্টদের খুব বেশী কষ্ট হওয়ার কথা নয়। গায়ের জোরে এরকম উদ্ভট সিদ্ধান্ত জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে চালাকি করে প্রকারান্তরে নিজেদের বুদ্ধির দীনতা প্রকাশ করার মাঝে কোন কল্যান নেই।‘করো নতি’ যাঁদের প্রাপ্য ছিল,তার বদলে সেসব উচচশিক্ষিত পন্ডিত শিক্ষকদেরকে যেন ছাত্ররা ‘ভয়ংকর’ বা ‘দূর্জন বিদ্বান’ আখ্যায়িত করে এড়িয়ে না চলে (ঠিক যেমনটি আমরা ‘মণি’ থাকা সত্ত্বেও সর্পকে এড়িয়ে চলি) সেদিকে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক দৃষ্টি দেওয়া উচিৎ।

Friday, October 10, 2008

ফিনিক্স পাখি এবং দুই নেত্রী



ফিনিক্স পাখির সাথে দুই নেত্রীর তুলনা করা হচ্ছে। প্রাচীন গ্রীক পূরা কাহিনী অনুসারে ফিনিক্স হল এমনই পবিত্র ‘অগ্নি-পাখি’ যার জীবন চক্র আবর্তিত হয় হাজার বছর ধরে। মনোলোভা স্বর্ণের লেজ এবং লাল, গোলাপী ও নীল রঙের পালক দ্বারা আবৃত ময়ুর সদৃশ এই পাখির প্রকৃত অর্থে কোন মৃত্যু নেই। হাজার বছর পূর্তি অর্থাৎ যমদূত আসার ঠিক আগেই দারুচিনি দিয়ে ফিনিক্স নিজের বাসা নিজেই বানিয়ে তা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। আর নির্মমভাবে দগ্ধীভূত এই পাখি ও তার বাসার ভস্ম থেকেই জন্ম নেয় নতুন ডিম্বের। প্রাণ পায় নব জীবনের, শুরু হয় আবারো জাতিশ্বর ফিনিক্সের অবিনাশী যাত্রা। বেঁচে থাকে পূর্ব জনমের আয়ুস্কালের মতই। কাহিনীমতে, ফিনিক্স পাখিকে হিংসুকেরা আঘাত করলে এর পালক থেকেও জন্ম নেয় নতুন প্রাণ।এদের চোখের পানিও বদলে দিতে পারে কারো জীবন। অগ্নি ও পবিত্রতার বদৌলতে এরা মৃত্যু পথযাত্রীদেরও সাময়িক জীবন দেয়ার ক্ষমতা রাখে।

প্রবীন রাস্ট্রবিজ্ঞানী তালুকদার মনিরুজ্জামান দুই নেত্রীকে কাল্পনিক অসাধারন ক্ষমতাধর এই পাখির সাথে তুলনা করেছেন। তাঁর কাছে নিশ্চয়ই যুক্তি রয়েছে। এই উপমহাদেশের কথাই ধরুন। ইন্দিরা গান্ধীর ভস্ম থেকে জন্ম নিয়েছে নতুন ফিনিক্স রাজীবের। রাজীবের পালক থেকে সোনিয়া, ‘অগ্নিমুখ’ থেকে এল রাহুল। জুলফিকার ভুট্টোর ‘গলার রশি’ ধরে থেকে জন্ম হলো ফিনিক্স পাখি বেনজীরের। তাঁর রক্ত ডিঙিয়ে চলে এল আসিফ জারদারী। জন্ম হল নতুন ফিনিক্স বিলাওয়ালের। বাপের সাথে মিলিয়ে নাম ছিল ‘বিলাওয়াল জারদারী’। কিন্তু ফিনিক্স পাকাপোক্ত করে নামও পালটে রাখা হল ‘বিলাওয়াল ভুট্টো’। শ্রীলংকার ফিনিক্সজনক হলেন সলোমন বন্দরনায়েকে। শত্রুর আঘাতে তাঁর ‘পবিত্রাগ্নি’ থেকে চলে এলেন একসাথে স্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে এবং মেয়ে চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গে। বাংলাদেশের অতীত ও ভবিষ্যত ফিনিক্স পাখিদের কথা সবার সামনে পরিস্কার থাকায় আলোচনা নাইবা করলাম।

ইতিহাসে সূত্র ধরে আপনাদের উপরো আঘাত এল । দুই দলেই জন্ম নিল কিছু ইঁদুরের। কেঁপে ঊঠছিলেন আপনারা। ভাবতেও পারেননি এত্থেকে আবার জেগে উঠবেন। কিন্তু ওই যে ফিনিক্স পাখি, আঘাত এলে আবার নতুন করে গজায়! আপনাদেরকে নিঃশেষ করতে পারেনি। তরবারীর নীচে মাথা রেখে কলমযোদ্ধারা জনতাকে জাগিয়ে দিয়ে জিতিয়ে দিল। বাংলার মানুষেরা প্রানভরে ভালবাসল। কিন্তু আপনারা কি নতুন করে জন্ম নিয়ে জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে নিতে পারবেন? সমগ্র দেশের নেত্রী হয়েও বিদেশে এসে সারাক্ষন যখন ‘দল’, ‘দল’ করেন, যারা বিদেশে বসে ‘দেশ’,’দেশ’ করে তাঁরা বড্ড অসহায় হয়ে পড়ে। আর ফখরুদ্দিন সাহেব তো আপনাদের দুইজনকে পেঁচিয়ে জাতিসংঘের সাধারন সভায় ২৬ সেপ্টেম্বরে গর্বের সাথে স্বদেশ সম্মন্ধে বললেন, ‘দশকের পর দশক ধরে চলে আসা দুর্নীতি দেশের গনতন্ত্র ও অর্থনীতিকে গ্রাস করেছিল’। গতবছর বলেছিলেন, ‘বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশে দুর্নীতির দুষ্টচক্রে গণতন্ত্রের উপাদানগুলো আবদ্ধ ছিল’। নিজের দেশ সম্মন্ধে সেই দেশেরই শীর্ষনেতৃবৃন্দের এরকম ‘নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মার্কা’ টাইপের কথাবার্তা পত্রিকায় প্রকাশ হয়ে পড়ায় বিদেশীদের নিকট থেকে মুখ লুকাবার জায়গা খুঁজি আমরা। ‘কার আমলে বেশী দূর্নীতি’ এ নিয়ে ঝগড়া বানরের তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে এক লাফ উপরে আর দুই লাফ নীচে নামাতেই জনম শেষ হয়ে যাবে, সমাধান মিলবেনা। যাহোক, পারবেন কি দলীয় গন্ডীর উর্ধ্বে উঠে মনটাকে আকাশের মত উদার করে সব মানুষকে ভালবাসতে? দলতো অনেক করলেন, দেখলেনও অনেক।জেনে গেলেন দৃশ্য-অদৃশ্য শক্তির নানান খেলা। আরো জানলেন, কারা আপনাদের সত্যি সত্যি ভালবাসে আর কারা আপনাদেরকে ভালবেসে চালাকি করে। জনতার কাতাড়ে না গিয়ে কোন্‌ শেকড়হীনেরা নিজেদের অস্তিত্ব বা গুরুত্ব বাড়াতে আপনাদের ব্যবহার করে? ঘৃণা ও বিভক্তির রাজনীতি করে। তাই বলে বলছিনা দল ছেড়ে দিতে। দলই আপনাদের পরিচয় বাড়িয়ে দিয়েছে, সত্য। বলছি মনটাকে অনেক বড় করতে।

ধরুন, আপনি ঢাকা থেকে বিমানে চড়ে বিদেশ যাত্রা করছেন। জিয়া থেকে একটু উপরে ঊঠেই হয়তো আপনি খোঁজার চেষ্টা করেন আপনার প্রাণপ্রিয় রাজনৈতিক দলের নয়াপল্টন বা বঙ্গবন্ধু এভিনিঊয়ের হেড অফিস। আর একটু উপরে উঠে দেখতে চান ঢাকা শহর, পরে খুঁজে ফেরেন বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষা আপনার প্রিয় মেগাসিটিকে। এক সময় হয়তো হাতড়ে খোঁজার চেষ্টা করেন সমগ্র বাংলাদেশটাকেই। সেটিও একসময় দৃষ্টির সীমানায় হারিয়ে যায়। এবার খোঁজেন উপমহাদেশ, তারপর এশিয়া। পার হয়ে যান একসময় প্রশান্ত মহাসাগর, আটলান্টিক মহাসাগর ইত্যাদি। এই আপনাকেই যদি মহাকাশের অভিযাত্রী বানিয়ে ছেড়ে দেয়া হয় মহাশুন্যের কোন গ্যালাক্সিতে, এবার আপনি দেশ মহাদেশের ঊর্ধ্বে উঠে খুঁজতে চাইবেন সমগ্র পৃথিবীটাকে।

ওবামা ও ম্যাককেইনের নির্বাচনী প্রচারনায় সারা আমেরিকানদের সাথে নিয়ে একসাথে কাজ করবার অভিপ্রায়ের কথা মনে পড়ছে। তাঁদের কথা আপনাদের মুখ দিয়ে বলায়েই না হয় আজকের আলোচনা শেষ করব।

কেন এমন হলো?
অন্তর্নিহিত রহস্য পূর্বে আঁচ করতে না পারলেও এটি ছিল গতানুগতিক হেঁয়ালী, একরোখা, পশ্চাদমূখী ও স্মরণশক্তিহীন বা ‘পরিবর্তনশীল দুনিয়ায় অপরিবর্তনশীল’ রাজনীতির লৌহ কপাটে আত্ম-উপলদ্ধির করাঘাত। সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন ও মেরুদন্ডহীন মনোবৃত্তির প্রতি প্রচন্ড বিদ্রোহ। দলীয় শৃংখলে আবদ্ধ হিংস্র ও বর্বর মানুষ পেটানো রাজনীতির বিপরীতে অমিয় সুবাতাসে দেশটাকে শান্তি ও উন্নয়নের মরু উদ্যানে পরিনত করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। স্তাবকদের শঠতা, মিথ্যা কুহেলিকা ছিন্ন করে প্রখর দৃষ্টি নিয়ে শত্রুকে চিনে সম্মুখপানে চলার প্রতিযোগিতা। মোদ্দাকথা, ব্যারিস্টার রফিকের ভাষায় ‘চোর-বাটপারদের’ চিরতরে কবর দেয়ার সাহসী চেতনাই যেন হয় ওয়ান ইলেভেনের শিক্ষা।

দেশের মানুষই এত্থেকে কিন্তু আপনাদেরকে উদ্ধার করল, দল করেনি। সাধারন মানুষ নামের অজেয় শক্তি এই মূহুর্তে অনেককেই মাইনাস করে দিল, আপনাদেরকে করেনি। সাথে আরো একটা বিষয় পরিস্কার হয়ে গেছে। সেটা হলো প্রতিটা রাজনৈতিক দলই এদেশের মাটি থেকেই উৎসরিত। প্রতিপক্ষ দলসমূকে কথায় কথায় ‘অমুক দেশের দালাল’, ‘তমুক দেশের আলাল’ বলে যে গালমন্দ করেন, কই তাঁরা তো কেউই আপনাদের উদ্ধার করতে এল না! বরঞ্চ দৃশ্য-অদৃশ্য বিনি সূতোর মালায় তাঁরা কি করেছে তা তো সাব-জেলে বসেই জেনেছেন নিশ্চয়ই। এদেশের সাধারন জনতাই আপনাদের উদ্ধার করেছে। দয়া করে তাদের ভালবাসাকে আর ফিরাবেন না।

দুই নেত্রীর মুখ চাওয়া-চাওয়ির কথা বলতেই ‘অসভ্য’ কথা বলার মহড়া আবার শুরু হয়ে গেছে। সংসদের বাইরে ‘পলিসি সামিট’ এই মূহুর্তে প্রয়োজন রয়েছে কিনা সে প্রসংগ বাদ দিয়েই বলতে পারি যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা গলদঘর্ম হয়ে যাবেন কিন্তু এরকম কোন সুশীল দেশ খুঁজে পাবেন না যেদেশে প্রতিদ্বন্দ্বী দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের মধ্যে ‘হ্যান্ডশ্যাক’ পর্যন্ত হারাম। কংগ্রেস-বিজেপি, পিপিপি-পিএমএল, মালয়েশিয়ায় বিএন-কাআদিলান রাকায়েতসহ দুনিয়ার সাপে নেউলে সম্পর্ক অন্যান্য দলের দিকে তাকালেও হিসাব মেলেনা। কানাডার কনজারভেটিভ-লিবারেলদের মধ্যকার উত্তপ্ত বাক্যবান দেখলে বাংলাদেশের সংসদের দৃশ্য সহজেই চোখে ভাসে। অথচ, পার্লামেন্ট ভাঙার আগে প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারের বাসভবনে আলোচনা করতে এসে বিরোধী দল নেতা স্টিফেন ডিওনের হাস্যরসাত্মক ছবি আমাদের জন্মভূমিতে কল্পনায়ও কেন পাইনা?

এমন তো হওয়ার কথা ছিলনা!
অতিথি আপ্যায়ন, এমনকি শত্রুকেও পাশে স্থান দেওয়ার হাজার বছরের সমৃদ্ধ কালচারের দেশে কোন্‌ স্তাবকেরা আপনাদেরকে মাটি নয় যেন ‘ধাতব পদার্থের তৈরী’ অতি দানবীয় রূপে রুপান্তরিত করে দিলো? অথচ, বার বার প্রধানমন্ত্রী ও মানুষের দৃষ্টিতে লৌহ মানবী হয়েও চল্লিশোর্ধ ছেলেকে জড়িয়ে পাগলের মত চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দেন, নবজাতক নাতী-নাতনীদের দেখার জন্য বা সদ্য প্রসূতা মেয়েকে অপত্য স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য পাগল হয়ে যান! এর উত্তর আগে জানলেও এখন বোধ করি আর অজানা নেই। আব্দুলদের মাইনাস করার মত আপনাদেরকে এই বন্দনা সৃষ্টিকারীদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। লন্ড্রী করা সাদা জামা-কাপড় পড়ে এসব মিডিয়া বাঘদের সুফী সুফী কথাবার্তা জাতি অনেক শুনেছে। এবার লুটেরা বা ‘মোর ক্যাথলিক দ্যান পোপ’ নয়, ইতিবাচক মনোবৃত্তির সত্যিকার দেশপ্রেমিকদের জাতি দেখতে চায়। প্রতিদ্বন্দ্বীতার চরম মূহুর্তে মাত্র চার হাজার মানুষের প্রানহানি নাইন ইলেভেনের সাত বছর পূর্তি উপলক্ষে রাজনীতি বাইরে রেখে ওবামা ম্যাককেইন এক মঞ্চে উঠতে পারলেও, লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগের দিনটিতেও আপনারা এক হতে পারেন না।

আপনারা কি পারবেন না ভবিষ্যত প্রজন্মের দিকে চেয়ে শুধু সামনের দিকের কথাই বলতে? অনেকযুগ তো পেরিয়ে এলেন। শুধু পেছনের দিনের কথা বলে জাতি কি কিছু পেয়েছে? চিরদিন বিভক্তি আর ঘৃণা নিয়ে কোন জাতি বাঁচতে পারে? কোন দেশের রাজনীতিই ‘অতীত’ নামক কুপমুন্ডকতা এভাবে জগদ্দল পাথরের মত ঘাড়ে চেপে বসে জাতিকে যুগের পর যুগ উস্কে দেয়না। আমেরিকায় ডেমোক্রেট রিপাবলিকান মোটামুটি সব প্রেসিডেন্টের ঝুলিতেই একাধিক কেলেংকারীর কলংক থাকলেও সমালোচনার তীর ঠিক আগেরজনের বেশী অতিক্রম করেনা। আর আমাদের দেশে আগেরজন তো দূরে থাক অশ্রাব্য বাক্যবানের শূল কারো জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে নিয়েও চলে। পুরাতন ফিনিক্সদের স্ব-স্ব অবস্থানে রেখে দিন, তাঁদের নিয়ে আর রাজনীতি করবেন না। এ বছর ৪ এপ্রিল আমেরিকার কালোদের প্রবাদপুরুষ মার্টিন লুথার কিং-এর ৪০ তম হত্যা দিবস উপলক্ষ্যে প্রার্থনা সভায় নিজের বাবার নির্মম হত্যাকান্ড স্মরন করে তার ছেলে চল্লিশ বছর পিছনে ফিরিয়ে না তাকিয়ে চল্লিশ বছর সামনের দিকে তাকাতে আমেরিকাবাসীদের আহবান জানিয়েছেন। বলেছেন, ‘পুরোন কথা তুলে এনে কি লাভ, চল্লিশ বছর পর আমরা দুনিয়াতে কি দিব তাই নিয়েই ভাবুন।‘

কি চাই এবার?
তাই বলছিলাম, আশার কথা শোনান। জাতিকে ভিশন ও বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা দেখান। রূপকথার গল্পের ফুলঝড়ি বা দুয়োরানী-সুয়োরানীর শোকগাঁথা কল্পকাহিনী নয়। সশ্রদ্ধা রেখেই বলছি, আপনাদের কেউ বলছেন ২০১৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে বিশ্বে একটি মধ্যআয়ের দেশে পরিনত করবেন, অত সালের মধ্যে নিরক্ষতামুক্ত দেশ উপহার দিবেন, ১০ টাকা কেজি চাল খাওয়াবেন ইত্যাদি।কিন্তু কিভাবে? সেটি নিয়ে ন্যুনতম কোন গবেষনা তো আপনাদের দলের ওয়েবসাইট বা কোথাও চোখে পড়ল না!

সবার আগে ঠিক করুন ‘স্ট্র্যাটেজিস্ট’ বা ‘কৌশলী’। বাংলার মানুষদের মনন , ঐতিহ্য ও মাটির গন্ধে মিশে আছে এবং গ্লোবাল পলিটিক্সের বর্তমান ধারা নখদর্পনে এমন আধুনিক এবং বিজ্ঞানমনস্ক মানুষদের নিয়ে গড়ে তুলুন ‘থিংক ট্যাংক’। আগে থেকে আপনাদের সেসব আছে কিনা জানিনা। থাকলে তা পালটিয়ে ফেলুন। কারন, তাঁরা যা দেবার, জাতিকে তা দিয়ে ফেলেছেন। রাস্তায় শবের উপর বিভীৎস নৃত্য ও ওয়ান ইলেভেনের ধারনা কয়েক বছর আগে কানাডিয়ান আইনজীবি উইলিয়াম স্লোন জানলেও আপনারা কিন্তু তা জানেননি। দেশজ থিংক ট্যাংক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ডালপালা আপনার পাশে থাকলে আগে থেকেই ইংগিত পেতেন। ইউএস ডিপার্টমেন্ট স্টেটের পলিসি ও প্ল্যানিং ডিরেক্টর রিচার্ড হায়াস এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বলেন, ‘Of many influenc on US foreign policy formation, the role of think tank is among the most important and least appreciated’।
ম্যাককেইনের দলীয় সম্মেলনে দেয়া ভাষন দিয়ে আজকের আলোচনা শেষ করার ওয়াদা প্রথমেই আপনাদেরকে দিয়েছিলাম। ওবামার কথাটাও এমনি ছিল। এবার সেটি কল্পনায় আপনাদের দুজনের স্ব স্ব মুখ থেকে পৃথকভাবে না হয় শুনে নেই! ‘বাংলাদেশীরা এক দল অন্য দলের বিরুদ্ধে আর বিষোদগার দেখতে চায় না। দেশের দুই দলের সদস্যদের সাথেই কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে। আমাদের মূল সমস্যাটা কোথায় তা আমি জানি। আর এও জানি নিরপেক্ষভাবে দলের উর্ধ্বে ঊঠে কিভাবে এর সমাধান করতে হয়। আসুন, আমরা সব দলের মধ্যকার ভাল ভাল ধারনাগুলো কাজে লাগাই। আমরা সবাই এক স্রষ্টার বান্দা, সবাই বাংগালী।এই বাংলাদেশের জন্যই আমি যুদ্ধ করেছি। আর এবার আমি ঠিক আপনার (অর্থাত দেশের মানুষের) জন্যই লড়ব’।