Wednesday, July 30, 2008

এক নরক শিবিরের কাহিনী




কিউবার একেবারে দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে গুয়ান্তেনামো উপসাগরের কোল ঘেঁষে অবস্থিত আমেরিকার বিতর্কিত ‘গুয়ান্তেনামো বে নৌ-স্থাপনা’। আমেরিকানরা একশো বছরের বেশী সময় ধরে স্থাপনাটি নিয়ন্ত্রণ করছে। ফ্লোরিডার মায়ামী বীচ থেকে প্রায় ৬০ মাইল দূরে দক্ষিণ দিকের উভয় অঞ্চলই ইউএস ‘জয়েন্ট টাস্ক ফোর্স গুয়ান্তেনামো’ নিয়ন্ত্রণ করছে। ১৮৯৮ সালের স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধ পরবর্তীতে আমেরিকা কিউবার কাছ থেকে জায়গাটি লীজ হিসেবে নেয়। ১৯০৩ সালে দুই দেশের ঐক্যমতের ভিত্তিতে লিজটি সম্পাদিত হয়। আর এটিকে ১৯৩৪ সালে চুক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়। কিউবার দৃষ্টিতে আমেরিকার বর্তমান উপস্থিতি অবৈধ। কারণ, বিশেষ পরিস্থিতিতে এ ধরনের সমঝোতা ১৯৬৯ সালের জেনেভার ভিয়েনা কনভেনশনের ‘চুক্তি আইন’ -এর ৫২ নং ধারা সরাসরি লংঘন করে। কিন্তু আমেরিকার পাল্টা কথা হল, লীজটি ভিয়েনা কনভেনশনের আগে হওয়ায় উক্ত চুক্তি আইনের ৪ নং ধারানুযায়ী তাদের উপর ৫২ নং ধারাটি মানা অপরিহার্য নয়। যুদ্ধ জয়ের পর কিউবার প্রথম প্রেসিডেন্ট হলেন জেনারেল টমাস এস্ট্রাডা পামা (Tomas Estrada Palma)। তিনি হলেন আমেরিকার নাগরিক । মে ২০, ১৯০২ থেকে সেপ্টেম্বর ২৮, ১৯০৬ সাল পর্যন্ত শাসন করেন। তিনিই দুই সহস্র মার্কিন স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে ৪৫ বর্গমাইল ব্যাপী দ্বীপটির নিয়ন্ত্রণভার নিতে আমেরিকাকে প্রস্তাব দেন ১৯০৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী। ১৯৩৪ সালে স্বর্ণমুদ্রার বদলে সমপরিমান অর্থ মার্কিন ডলারে ৪,০৮৫ ধার্য্য করে নতুন চুক্তি সাধিত হয়। এভাবেই গুয়ান্তেনামো বে’র শিবিরটিকে স্থায়ী নিয়ন্ত্রনে নেয় আমেরিকা যুক্তরাস্ট্র। বারে বারে টানাপোড়ন চলতে থাকলেও দুদেশের মধ্যে ঐক্যমত বা আমেরিকা স্বেচ্ছায় ছেড়ে না দিলে অথবা আরেকটি বিশেষ কারন আসা না পর্যন্ত আজীবন এটি ইউএস নৌ-বাহিনীর একটি স্থাপনা হিসেবেই ব্যবহৃত হতে থাকবে।

এই স্থাপনায় মোট তিনটি ক্যাম্প রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ রয়েছে এগুলোতে বন্দীদের নির্যাতন করা হয় । নামগুলো হল, ‘ক্যাম্প ডেল্টা (Camp Delta)’, ‘ক্যাম্প ইগোয়ানা (Camp Iguana)’ ও ‘ক্যাম্প এক্স-রে (Camp X-ray)। ক্যাম্প এক্স-রেটি বর্তমানে বন্ধ আছে।

নাইন-ইলেভেনের পেট ফুঁড়ে অনেক অবৈধ সন্তানের জন্ম হয়েছে। তার একটির নাম হল গুয়ান্তেনামো বে’র এই ডিটেনশন ক্যাম্প বা বন্দী শিবির । সংক্ষেপে একে ‘গিটমো (Gitmo)’ বা GTMO-ও বলা হয়। এই ক্যাম্পের নাম শুনলেই একটি দৃশ্য সবার চোখের সামনে ভেসে উঠে । তাহলো, পেছন দিক থেকে দুই হাত-পা বাঁধা, মাথা থেকে গলা পর্যন্ত ঢাকা কমলা রঙের কাপড় পরিহিত একদল মানুষদের জন্তুর মত খোঁয়াড়ে রেখে আমেরিকান সৈন্যদের পাহারা দেয়ার দৃশ্য। জীবন্ত মানুষদের উপর কত রকমের যে নির্যাতন চালানো যায় তার ছিটেফোঁটা ছবি বিভিন্ন ফূটেজে দেখে পৃথিবীর তাবৎ বিবেকবান মানুষদের বাকরুদ্ধ হওয়ার বাকি নেই। সন্ত্রাসী হিসেবে প্রমাণ করতে শুধু অভিযোগের ভিত্তিতেই চলছে এসব অত্যাচার। এতই ভয়ঙ্কর সেসব অত্যাচার যে, তা চালাতে গিয়ে খোদ নির্যাতনকারীদেরই অনেককে পাগল হতে হয়েছে। মাথা থেকে ঘাড় পর্যন্ত ঢেকে দু’হাত পেছনদিকে পিঠমোড়া করে বেধে ইলেকট্রিক তার পায়ের সাথে লাগিয়ে হতভাগা বন্দীদের ছোট্ট এক খন্ড পাথরের উপর রাতদিন উঠবস করা হয়। যার বিরুদ্ধে অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেটে জনপ্রিয় ‘আনসাবসক্রাইব (Unsubscribe)’ আন্দোলন শুরু করেছিল। দুনিয়ার এই দোযখকে সাবেক সোভিয়েত কম্যুনিষ্ট গুপ্তচর কর্তৃক শ্রমিকদের উপর নির্যাতনের ক্যাম্প ‘গুলাগ (Gulag)’-র সাথে তুলনা করেছিলেন সংস্থাটির সেক্রেটারী জেনারেল আইরিন খান। তার এই সাহসী উচচারনে বুশ, চেনী, রামসফেল্ড সবাই ক্ষেপেছিলেন। যথাক্রমে তারা বলেছিলেন ‘উদ্ভট (absurd)’,‘পীড়াদায়ক (offended)’, ও ‘নিন্দাযোগ্য (reprehensible)’ অপরাধ। পৃথিবীর সব মানবাধিকার সংস্থাসমূহ এই অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে ক্যাম্পগুলো বন্ধের দাবী জানিয়ে আসছে বহুদিন ধরে।
২০০২ সালের জানুয়ারী মাসে আফগানিস্তানের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ৭৭৫ জন যুদ্ধ-বন্দীদের এখানে ধরে আনে আমেরিকা যুক্তরাস্ট্র। ‘বৈধ’ ভাবে জঘন্য অত্যাচার চালানোর কুমতলবে তারা ঘোষণা দেয় এসব বন্দীদের অধিকার জেনেভা কনভেনশন কর্তৃক ‘যুদ্ধ-বন্দী আইন’ দ্বারা সংরক্ষিত নয়। তার মানে হল, এদের উপর আচরণে কোন নিয়ম কানুন না মানলেও চলবে। ‘যুদ্ধবন্দী (Prisoner of War)’ নাম পালটে এদেরকে বলা হল ‘শত্রুযোদ্ধা (Enemy Combatant)’। টানা চার বছর অকথ্য নির্যাতন শেষে মার্কিন উচচ আদালত ২০০৬ সালের ২৯ জুন ঘোষণা দেয় এরা ‘শত্রুযোদ্ধা’ নয়, ‘যুদ্ধবন্দী’। আমেরিকার প্রতিরক্ষা বিভাগ ওই বছর জুলাই ৭-এ আভ্যন্তরীন একটি মেমো দিয়ে বিশ্ববাসীকে এই বলে সান্ত্বনা দিল যে, ‘হুম্‌, ভবিষ্যতে তাদের সে মর্যাদা দেয়া হবে’। তবে সেই মর্যাদা কবে থেকে দেয়া শুরু হবে, সুনির্দিষ্টভাবে তা না বলে মানবাধিকার সংগঠনসমূহদের অন্ধকারে রাখা হল।

অনেক চেষ্টার পরেও ৯/১১-এর সাথে সংশ্লিষ্টতার স্বীকারোক্তি আদায় করতে না পেরে এদের মধ্যে ৪২০ জনকে ছেড়ে দেয়া হয়। মে ২০০৮ পর্যন্ত আনুমানিক ২৭০ জন যুদ্ধ বন্দী এই ক্যাম্পে আটকাবস্থায় দিনাতিপাত করছে। পেন্টাগন বলছে (ফেব্রুয়ারী ৯, ২০০৮), এদের মধ্যে মাত্র ৬ জনকে ৯/১১ এর সাথে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগে বিচার করা হবে। তারা আশা করেছিল এ সংখ্যা ৬০ থেকে ৮০তে দাঁড়াবে। এটা যেন ঠিক ‘স্যাম্পল থিউরী (Sample Theory)’-র ম্যাস (mass) প্রোডাক্টশনের ব্যাচ থেকে এক্সপেরিমেন্টের জন্য কিছু সিলেকশন অথবা জন্তু-জানোয়ারের পাল থেকে বেছে বেছে তরতাজা কয়েকটা পশু ধরে কুরবানীর জন্য নিয়ে আসার মত random selection।

এই হতভাগা মজলুম বনি-আদমদের মুখ দিয়ে জোর করে কথা বের করে আনার জন্য যে বর্বর পদ্ধতিসমূহ প্রয়োগ করা হয়েছে বা এখনো হচ্ছে তা বর্ণনা করলে যে কোন মানুষের হৃদয় কেঁপে উঠবে। তার একটি হল ‘স্লিপ ডিপ্রাইভেশন (Sleep Deprivation)’ বা ‘নিদ্রা-প্রবঞ্চণা’। হেরাল্ড ট্রিবিউন জুলাই ২, ২০০৭ এ লিখেছে, এই পদ্ধতিটি তারা চীনা কমিউনিস্টদের কৌশল থেকে নকল করেছে যারা কিনা কোরিয়ান যুদ্ধের সময় প্রয়োগ করত। এ পদ্ধতিতে কাউকে নিদ্রা থেকে একাধারে অনেকদিন বঞ্চিত রেখে ঘুমুতে দিয়েই হঠাৎ জাগিয়ে তুলে আবার জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হয়। ইসরাইলের সাবেক প্রধাণমন্ত্রী (১৯৭৭-১৯৮৩) মেনাসেম বেগিন (Menachem Begin) রাশিয়ান গোয়েন্দা সংস্থা ‘কেজিবি’ কর্তৃক তার নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘ক্রমাগত নিদ্রাহীনতার কারনে মাথার ভিতরে এক ধরণের কুঞ্ঝঘটিকা বা এলোমেলোভাব সৃষ্টি হয়। মন-প্রাণ ক্লান্তিতে বিষে যায়, পা দুটো মনে হয় শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন। তখন জীবনে একটাই চাওয়া থাকে, তা হল ‘ঘুম’।‘ তিনি বলেছেন, ‘যার অভিজ্ঞতা আছে কেবলমাত্র সেই-ই বলতে পারবে, এর সাথে ক্ষুধা বা তৃষ্ণার কোন তুলনা চলেনা। অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল একে চিহ্নিত করেছে ‘বর্বর’, ‘অমানবিক’ ও ‘মানবতার বিরুদ্ধে চরম অপমানজনক’ পদ্ধতি হিসেবে।

‘ওয়াটারবোর্ডিং (Waterboarding)’ হল আরেকটি নির্যাতনের পদ্ধতির নাম। এই পদ্ধতিতে হাত-পা বেঁধে শুইয়ে মাথা থেকে গলা পর্যন্ত কাপড় দিয়ে ঢেকে মাথা কাত করে উপর দিক থেকে পানি ঢালা হয়। নির্যাতিত মানুষটি নিঃশ্বাস বন্ধে ছটফট করতে থাকে, ভাবে পানিতে ডুবে বুঝি এখনই তার মৃত্যু হবে। এভাবেই চলতে থাকে জোর করে স্বীকারোক্তি আদায়ের নামে ‘ইন্টারোগেশন’! বাহ্যত. শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন না থাকায় এই পদ্ধতিটি আমেরিকান সৈন্যদের মাঝে বেশ জনপ্রিয়, যদিও এর প্রভাবে শরীরে প্রচন্ড ব্যথা, মস্তিস্ক ও ফুসফুসের স্থায়ী ক্ষতিসহ বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টায় হাত-পা ও শরীর প্রচন্ডভাবে আন্দোলিত হওয়ায় হাড়-গোড় ভেঙে যাওয়া এমনকি মৃত্যুর সম্ভাবনাও রয়েছে। ২০০৭ সালে প্রথম প্রকাশ হয়ে পড়ে যে, নিয়মিত বিচারের আওতায় না এনে সি.আই.এ এই পদ্ধতিটি তিনজন সন্দেহভাজন সন্ত্রাসী (খালেদ শেখ মোহাম্মদ, আবু যুবায়দা ও আব্দাল রাহিম আল নাশরী)-এর উপর প্রয়োগ করে আসছে। আর এই জঘন্য পদ্ধতিটি কিনা অনুমোদন করেছিল আমেরিকার খোদ ‘জাস্টিস্‌ ডিপার্টমেন্ট’! অবশ্য, উচচ আদালত এতদিনে তাদেরকে ‘যুদ্ধবন্দী’ হিসেবে মর্যাদা দেয়ার কথা বলছে।
এতসব নির্যাতন সইতে না পেরে এ পর্যন্ত চারজন জনম-দুঃখীর আত্মহত্যার খবর দুনিয়ার মানুষ জানতে পেরেছে। পাশাপাশি পত্রিকায় এসেছে শত শত আত্মহত্যা প্রচেষ্টার খবরও। বিচারের আগেই খেতাবপ্রাপ্ত এসব সন্ত্রাসী বন্দীদের কাছে দুনিয়ার জীবন বুঝি আর শেষ হতে চায় না। এরা বুঝি এখন আর মানুষ নয়! তিনজন বন্দীর মরা লাশ পাওয়া গেছে জুন ১০, ২০০৬-এ। আমেরিকার সামরিক সদর দপ্তর পেন্টাগণ বলেছে, ‘আমাদের (অর্থাৎ আমেরিকানদের) উপর অপরাধ চালানোর অনূশোচনা থেকেই তাদের এসব আত্মহত্যা!’ একেই বলে সভ্যতার চরম অপমান, মানবতার বুক ফাঁটা ক্রন্দন!

কানাডার নাগরিক তরুন যুবক ওমর খাদরের উপর নিদ্রা-প্রবঞ্চণা পদ্ধতিসহ বিভিন্ন প্রকারের অত্যাচার চালনা হয়েছে উক্ত নরক শিবিরে। আফগানিস্তানে এক আমেরিকান সৈন্য হত্যার অভিযোগ তাকে ধরে আনা হয় ২০০২ সালে। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। গত ১৫ জুলাই ২০০৮ এ তার আইনজীবি ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারীতে ধারণ করা ইন্টারোগেশনের ভিডিও টেপ প্রকাশ করেছেন । উদ্দেশ্য হল, কানাডিয়ানদের সহানুভূতি জাগ্রত করা যাতে করে কানাডিয়ান সরকার গুয়ান্তেমো বে’র বন্দীশালা থেকে ওমরকে তার নিজ দেশে ফেরৎ এনে স্বদেশের আইনে সোপর্দ করে। এতে দেখানো হয়, ছেলেটির গগণবিদারী চিৎকারে পাষন্ডদের হৃদয় এতটুকুও টলেনি। ওমরের মায়ের বুক চাপড়ানোর দৃশ্য টিভিতে দেখলে কেউই চোখের পানি আটকিয়ে রাখতে পারবে না।

ভিডিও ফুটেজে দেখানো হয়েছে, ওমর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কানাডিয়ান গোয়েন্দা সংস্থার এক এজেন্টকে বলছে, ‘হয় আমাকে বাঁচাও, নয়তো মেরে ফেলো (Kill me or Help me)’। ‘নিদ্রা-প্রবঞ্চণা’ তাকে এমনভাবে শেষ করে ফেলছে যে, সে বাস্পরুদ্ধ কন্ঠে করে বলে যাচ্ছে, ‘আমার হাত নাই, পা নাই চোখ নাই’। সাক্ষাৎকার নেয়া কর্মকর্তা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছে, ‘না, তোমার তো সবই আছে। এই যে তোমার হাত, ওই হল তোমার পা, তোমার চোখ, সবই আছে’। ওমর বলছে, ‘না আমার কিচ্ছু নাই, তোমরা আমায় যত্ন নিচ্ছ না, তোমরা আমাকে মেরে ফেলো, না হয় বাঁচাও’। চিৎকার করে সে তার মাকে ডাকছে ‘ইয়া উম্মী’, ‘ইয়া উম্মী (মা, আমার মা)’। তার মা মাহা আল-সামনাহ্‌ পরদিন (জুলাই ১৬, ২০০৮) সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার ছেলে আমাকে ডাকছে, আর আমি এখানে বসে আছি। আমি আর পারছি না।‘ তিনি বলেন, ‘আমি কাঁদছি। খোদা, এখানে বসে বসে তাকে ডাকা ছাড়া আমি কিইবা করতে পারি। আহ্, আমার ছেলে যদি আমার আমার উত্তর শুনত! খোদা, তুমিই তার ডাকের উত্তর দাও।‘

আরেকজন বন্দীর নাম ত্রিশ বছর বয়স্ক সেলিম হামদান। নভেম্বর ২০০১-এ আফগানিস্তান থেকে ধরে এনে ৬ বছর ধরে ওই ক্যাম্পে সব ধরনের নির্যাতন চালানো হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হল, বিন লাদেনের ট্রাক ড্রাইভার ও আল-ক্বায়েদার সদস্য, যদিও সে এসব অস্বীকার করছে। ইউএস সুপ্রীম কোর্ট কর্তৃক যুদ্ধবন্দীদের সাংবিধানিক অধিকার সংক্রান্ত সাম্প্রতিক ঐতিহাসিক রুলিং জারির পর জুলাই ১৬, ২০০৮ এ তাকে নিয়মিত আইনের আওতায় এনে শুনানী শুরু করা হয়। আদালতে সে বর্ণনা করেছে, কিভাবে ৫০ দিন ধরে তার উপর নির্যাতনের বিভিন্ন পদ্ধতি যেমন, নিদ্রা-প্রবঞ্চণা, যৌন নিপীড়িনসহ নানা ধরনের অত্যাচার করা হত। শ্রান্ত-ক্লান্ত শরীর ঘুমের জন্য এলিয়ে দেয়ার পাঁচ-দশ মিনিটের মাথায়ই দরজায় কান ফাটানো আওয়াজ দিয়ে উঠিয়ে আবার শুরু হত জোর করে স্বীকারোক্তি আদায়ের প্রচেষ্টা। সেলিমের আইনজীবি গত ২১ জুলাই মার্কিন আদালতে বলছে, ‘তার মক্কেল আল-ক্বায়েদার সদস্য নয়, কোন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সাথেও জড়িত নয়। নিজের বড়সড় পরিবারটি চালাতে সে মাসিক দুইশো ডলারের বিনিময়ে ছিল একজন লো-লেভেলের ট্রাক ড্রাইভার’। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইয়েমেনী নাগরিক সেলিম হামদানই প্রথম যার বিরুদ্ধে যুদ্ধ অপরাধের অভিযোগে বিচার চলছে । অনুমান করা হচ্ছে, ওমর খাদর হবে এদিক থেকে দ্বিতীয়। অক্টোবরে তার শুনানী শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।



উপসংহারে বলা যায়, যেকোন সন্ত্রাসী, দূর্নীতিবাজ বা দুস্কৃতিকারীদেরকে তড়িঘড়ি করে ধরে এনে নিয়মিত বিচারের সম্মুখীন করে তাদের সর্বোচচ সাজা নিশ্চিত করাতে যেকোন সরকারের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। সবারই কাম্যও তাই। এতে করে একটি দেশে আইনের শাসন নিশ্চিত হয়। সাথে সত্যিকারের অপরাধীরাও দূর্বল হয়। তাছাড়া, কোন সুস্পষ্ট প্রমাণ ব্যতিরিকে কাউকেই সন্ত্রাসী বা দাগী আসামী আখ্যা দিয়ে সম্পূর্ণ অনুমানের উপর ভিত্তি করে অকথ্য নির্যাতন চালানো পৃথিবীর কোন দেশের আইনই অনুমোদন করেনা। ক্ষমতা থাকলে কাউকে ধরে এনে চোখ, মুখ বেঁধে পিটিয়ে হাড়-গোড় ভেঙে নির্যাতন চালানো অত্যন্ত সহজ কাজ, এটা নিশ্চয়ই কোন কৃতিত্বের কাজ নয়। আর আন্তর্জাতিক বিধি মোতাবেক প্রতিটি দেশের সংবিধানই বন্দীসহ যেকোন মানুষের ন্যায্য প্রাপ্য নাগরিক-অধিকার পাওয়ার যোগ্যতা নিশ্চিত করেছে। ন্যায়দন্ড সমুন্নত রাখাই অন্ততপক্ষে ক্ষমতাবানদের ব্রত হওয়া উচিৎ। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পূর্বে কম্যুনিস্টরা যুদ্ধবন্দীদের উপর এসব পদ্ধতি প্রয়োগ করত আর দেশ হিসেবে আমেরিকা যুক্তরাস্ট্র ছিল এর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশী সোচচার। আর আজ তারাই ওই পদ্ধতিগুলো কমুনিস্টদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে শিখে উলটো ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ বানিয়ে বন্দীদের উপর হুবহু প্রয়োগ করতে এখন লজ্জা পাচ্ছে না।