Tuesday, August 12, 2008

রাহুল গান্ধীর ‘ব্যক্তিগত সফর’ এবং আমাদের ‘বস্তি-দর্শন’ সংস্কৃতি



পাঁচদিন ‘ব্যক্তিগত সফর’ শেষ করে ভারতের লোক সভার সদস্য ও গান্ধী পরিবারের তরুন উত্তরাধিকারী রাহুল গান্ধী ৫ আগস্ট ঢাকা থেকে দিল্লী ফিরে যান। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া (পিটিআই) তার এই সফরকে ‘ব্যক্তিগত সফর’ নামে অভিহিত করে ইনভার্টেড কমা দ্বারা শব্দ দুটিকে আবদ্ধ করে দিয়েছে। আমরা সবাই জানি, কোন শব্দকে ইনভার্টেড কমা দ্বারা আবদ্ধ করার অর্থ হলো ওই কথার সাথে বক্তা ঐকমত্য পোষন নাও করতে পারেন। অবশ্যি বাংলাদেশীয় সব গণমাধ্যমই সরল বিশ্বাসে তার বাংলা দর্শনকে ‘শিক্ষা সফর’ নাম দিয়ে ফলাও করে প্রচার করেছে। আমরাও বিশ্বাস করতে চাই, তিনি আমাদের অসৎ প্রতিবেশী নন।

উপমহাদেশের বিখ্যাত এক পরিবারের সদস্য তিনি। সেই সুবাদে প্রাচীন ও বড় দল কংগ্রেসের সাধারন সম্পাদকও বটে। তিনি এক স্থানে বলেছেন, তার পরিবার যা চায় তাই হয়। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির উদ্ভব নেহেরু-গান্ধীপরিবারের ধারনা থেকেই উৎসরিত। এমন অপমানজনক কথা নিয়ে বাংলাদেশে উচ্চবাচ্য না হলেও খোদ ভারতের এমন কি পাকিস্তানের ফরেন অফিসও প্রতিবাদ পাঠিয়েছিল। এই প্রেক্ষিতে উপমহাদেশের নামকরা ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব বলেছেন”....... an insult to the Bangladesh movement. Rahul is free to say whatever he wants to, but in a democratic country playing up family is certainly not in good taste।“
অর্থাৎ এর মাধ্যমে রাহুল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে অপমান করেছে। সে যা খুশী তাই বলতে পারে কিন্তু পরিবার নিয়ে খেলা করা কোন গনতান্ত্রিক দেশের জন্য ভাল দৃষ্টান্ত নয়।

১৯৯২ সালে নরসীমা রাওয়ের আমলে বাবরী মসজিদ ভাঙার প্রসঙ্গে টেনে এনে রাহুল তার উত্তর প্রদেশ নির্বাচনে বলেছিলেন, ‘সে সময়ে গান্ধী-নেহেরু পরিবারের কেউ রাজনীতিতে জড়িত থাকলে এরকম ঘটনা ঘটত না।‘ বারে বারে পরিবার নিয়ে তার এরকম দেমাগোক্তিতে বিরুক্তি হয়ে দক্ষিনের বিজেপি নেতা বেংকাইয়া নাইডু বলেছেন, ‘তাহলে জরুরী অবস্থা আগমনের দায়িত্বও গান্ধী পরিবারকে নিতে হয়!‘

আমরা রাহুল সম্মন্ধে খানিকটা জানার আগে দেখি, কেমন কাটালেন ভারতের হবু প্রধানমন্ত্রী আমাদের নতুন অতিথি।

দিল্লীতে ফেরত যাওয়ার আগেরদিন বাংলাদেশ সম্পর্কে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রসমাবেশে তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ সম্পর্কে যে ধারণা দেয়া হয়েছিল এখানে এসে তা পাল্টে গেছে। আমাকে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ একটি চরম মৌলবাদী মুসলিম সাম্প্রদায়িক দেশ। এখানকার জনগণ অত্যন্ত দরিদ্র। কিন্তু বাস্তবে এসে আমার মনে হয়েছে যে, এখানকার লোকজন অত্যন্ত উদার প্রকৃতির। চরমপন্থী কোনো মৌলবাদী দেশ এটা নয়। জনগণ সহজ সরল প্রকৃতির। অর্থনৈতিকভাবেও এখানকার অবস্থা যতটা খারাপ বলা হয়েছে ততটা নয়। ভারতের গরিব মানুষের চেয়েও এখানকার দরিদ্রদের অবস্থা ভালো। তিনি দুই দেশের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর আহ্বান জানান।‘ তাকে কারা বাংলাদেশ সম্পর্কে এরকম ধ্বংসাত্মক ধারনা দিয়েছেন তা আমরা জানি না। কারন এসব খারাপ কাজ সাধারনত দিনের আলোতে কেউ বলে কয়ে করেনা। তার কোন রেকর্ডও থাকেনা। সে যাহোক, ভারতের রাজনীতিতে সৌভাগ্যবান ব্যক্তি রাহুল গান্ধী বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন নোবেল বিজয়ী ডঃ মুহম্মদ ইউনূসের এনজিও গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্র্যাক সেন্টারের আমন্ত্রনে। এরকম খবরই অন্ততঃ আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পেরেছি। যদিও ‘দৈনিক আমাদের সময়’ ৬ আগস্ট লিখেছে, ‘এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ব্র্যাকের ম্যানেজার (কমিউনিকেশন) পুষ্পিতা আলম বিস্তারিত জানাতে রাজি হননি।‘ তিনি জানিয়েছেন, আসলে ব্র্যাক ও গ্রামীণ ব্যাংকের আমন্ত্রণে রাহুল গান্ধী বাংলাদেশে আসেননি’।

গত পাঁচ দিন রাহুল গান্ধী মহাখালীতে ব্র্যাক সেন্টারের ব্র্যাক ইনে অবস্থান করেন। এ সময় তার ও তার প্রতিনিধি দলের থাকা-খাওয়ার খরচ তারা নিজেরাই বহন করেন। কূটনৈতিক সূত্র বলেছে, রাহুলকে দেওয়া নিরাপত্তা বাহিনী এসএসএফের খরচ বহন করেছে বাংলাদেশ পররাস্ট্র মন্ত্রনালয়। কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সফরকালে রাহুল গাজীপুরে ব্র্যাক কর্মসূচি ও মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে গ্রামীণ ব্যাংক কর্মসূচি পরিদর্শন করেন (দৈনিক সমকাল, ৬ আগস্ট)। তার নিরাপত্তায় বাংলাদেশের সবগুলো নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ছাড়াও ভারত থেকে স্পেশাল প্রোটেকশন গ্রুপ (এসপিজি)-এর ১০ সদস্যের একটি দল ঢাকায় আসে। রাহুল ভারতে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা জেড-প্লাস পেয়ে থাকেন।

তিনি তার সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে এসে বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদে বাস করা মানুষদের আর্থ-সামাজিক অবস্থানের উন্নয়নের চিত্র সম্বন্ধে ধারণা লাভ করেন বলে জানা যায়। বাংলাদেশের গ্রামীন জনপদ ও ভারতের বৃহত্তর অঞ্চলের গ্রামীন জনপদের মানুষদের বসবাসে মৌলিক পার্থক্য কতটুকু, তা তিনিই এখন ভাল বলতে পারবেন। এবার আমরা একটু নজর দিই আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহভারতের গ্রামীন জনপদে বাস করা মানুষদের সম্মন্ধে কি রিপোর্ট দেয়। দি ইন্ডিয়া টাইমস ১৮ এপ্রিল লিখেছে, সহস্রাব্দ উন্নয়ন গন্তব্য (Millennium Development Goal) ধরা ভারতের জন্য এখন অলীক স্বপ্নবৈ অন্য কিছু নয়। ইউএন চিল্ড্রেন্স ফান্ড ভারতকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে সেদেশে শিশু মৃত্যর হার আশংকাজনকভাবে নাগালের বাইরে যাওয়ায় যা তার প্রতিবেশী দেশসমূহের চেয়েও অনেক গুন বেশী। ইউনিসেফের প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ডিরেক্টর ড্যানিয়েল টুল (Daniel Toole) বলেছেন, ভারতে ৫ বছরেরও কম বয়সের ২.১ মিলিয়ন শিশু মারা যাচ্ছে প্রতি বছর।মেয়ে শিশুরা ন্যুনতম মৌলিক চিকিৎসাও পাচ্ছে না। আজো সেদেশে মেয়ে শিশুদের অনার কিলিং (honour killing) হয়। হু
(WHO) বলেছে, ‘বিভিন্ন সেক্টরেভারতে উন্নয়নের জোয়ার বইছে একথা যেমন সত্য, প্রতি দশজন
শিশুর একজন অপুষ্টিতে ভুগছে একথাও সমান সত্য।ভারত অচিরেই বিশ্বের ক্ষুধার্ত দেশসমূকে নেতৃত্ব দিবে।’
তাই সংগত কারনেই প্রশ্ন জাগে, ভারতে ছেড়ে বাংলাদেশের গরীবদের জানা তার আদৌ প্রয়োজন রয়েছে কিনা।
ভাঙা চালের চা-স্টলে বসে চা পান করা কিংবা গ্রামে গিয়ে সাধারন মানুষদের সাথে ড্রাম বাজিয়ে নেচে গেয়ে
অভিজ্ঞতা অর্জন করা রাহুলের জন্য কি সত্যি মানায়? কেন যেন আমাদের দেশটা টুরিজমের তালিকায় বস্তি, ভাঙা
চাল, কিংবা ছিন্নভিন্ন নতুন করে স্থান পেয়ে গেল। হিলারী ক্লিনটনকে দিয়ে ডঃ ইউনুস যে যাত্রা শুরু করে দিয়ে
গেলেন, আজ মনে হয় তা সব এনজিওর জন্য অনুকরনযোগ্য ।

এছাড়া মিঃ জুনিয়র গান্ধী আরো একটি কাজ করেছেন। পত্রিকায় এসেছে, ‘রাহুল গান্ধীর সাথে গতকাল দেড় ঘণ্টারও বেশি সময় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) কর্মকর্তা ও সমমনা বুদ্ধিজীবীদের এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। মিরপুরে গ্রামীণ ব্যাংক ভবনে অনুষ্ঠিত এ বৈঠক সম্পর্কে কেউই মুখ খুলতে রাজি হননি। বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে সন্ধ্যা সোয়া ৬টা পর্যন্ত বৈঠকটি চলে। বৈঠকের আগে সেখান থেকে টিভি ক্যামেরাম্যান এবং সাংবাদিকদের বের করে দেয়া হয়। সাবেক সিপিবি ঘরানার বুদ্ধিজীবীদের সাথে উক্ত বৈঠকে কী নিয়ে আলোচনা হয়েছে এ কথা জানতে চাইলে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাংবাদিকদের বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত গোপনীয় এবং এ বিষয়ে কথা বলা যাবে না। একদম নিষেধ করে দিয়েছেন।‘ এ কথা বলে তিনিও বেরিয়ে যান। বৈঠকে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড· মোস্তাফিজুর রহমান, ট্রাষ্টি সৈয়দ মঞ্জুর এলাহি, ব্যবসায়ী লতিফুর রহমান, আনিসুল হক, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, সাবেক উপদেষ্টা এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক চক্রবর্তীও এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বলে জানা যায়।‘ (সূত্রঃ নয়াদিগন্ত ও ইত্তেফাক ৫, ২০০৮)

গোপনীয় বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। সাংবাদিকেরা অনেক সময় অপছন্দের ব্যক্তিদের নিয়ে এলোমেলো কথা প্রকাশ করেন, যার জন্য শেষে অনেকেই লজ্জাজনক পরিস্থিতির শিকার হন। তাই আমরা কষ্ট করে হলেও ধরে নিলাম, উক্ত বৈঠকে মিডিয়া এড়িয়ে কানে কানে আমাদের সমাজের ব্রাহ্মগোত্র ভুক্ত সুশীল গোষ্ঠী রাহুলকে বুঝিয়েছেন, সিডর আক্রান্ত মানুষদের সাথে ৫ লাখ টন চাল দিবে বলে যে প্রতারণা করলে তা ঠিক করোনি, সীমান্তে পাখির মত গুলি করে আর মানুষজন মেরোনা, ট্রানজিট নিয়ে এরকম অযৌক্তিক জিদ ধরলে কি হয়, ফারাক্কার পানি ঠিকমত দিয়ে দাও, স্বাধীনতা যুদ্ধের পাওনাগুলো তাড়াতাড়ি মিটিয়ে দাও, আমাদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরন করোনা ইত্যাদি। বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবিরা নিশ্চয়ই তাকে বুঝিয়েছেন, দেখো নিছক এসব কারনেই এদেশের মানুষ বারে বারে এক অখ্যাত মেজরের অসংগঠিত দলকে ক্ষমতায় বসায়।

আমাদের বস্তি-দর্শন সংস্কৃতি সম্মন্ধে জানার আগে শ্রীমান রাহুল গান্ধী সম্মন্ধে আর একটু জেনে নেই।
বিভিন্ন কারনে তিনি ভাল কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি। বন্ধুরা বলে, তিনি খুবই লাজুক প্রকৃতির । তাই এসব বিষয়ে নিয়ে খুব খোলাসা করে কিছু বলেনও না। পশ্চিমে কাউকে রাজনীতি করতে গেলে প্রচুর ঘাম ঝড়াতে হয়। মেধাবী হতে হয়, পড়তে হয় নামকরা ইউনিভার্সিটিত, আইন বিষয়ে অনেক পড়তে হয়। কিন্তু আমাদের উপমহাদেশ এর ব্যতিক্রম। আজকাল কোন পলিটিশিয়ানেরই মেধাবী ছেলে-মেয়েরা রাজনীতিতে আসে না। কারন, এটা অত্যন্ত দূষিত ও নোংরা পরিবেশ। তাই পরিবারের বিগড়ে যাওয়া সন্তানদের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয় রাজনীতিকেই অবশিষ্ট ক্যারিয়ার নির্মানের সোপান হিসেবে।

রাহুল গান্ধী নয়াদিল্লীর মডার্ণ স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা নেন। ওই সময়ে পাঞ্জাবে চলছিল ব্যাপক সহিংসতা যার ফলে তার দাদী ইন্দিরা গান্ধীকে প্রান হারাতে হয় (অক্টোবর, ১৯৮৪)। স্কুল ছেড়ে বোন প্রিয়াংকা সহ তিনি বাড়ীতেই পড়তে থাকেন। ১৯৮৯ সালে সেন্ট স্টিফেন কলেজে ইতিহাসে ভর্তি হন। কিন্তু মাত্র এক বছরেই ডিগ্রী না নিয়ে কলেজ ছাড়তে হয়। এই কলেজে তিনি মেধার ভিত্তিতে সুযোগ না পেয়ে স্পোর্টস (শুটার) কোটায় ভর্তি হন। কলেজের অধ্যক্ষ ডঃ অনল উইলসন বলেন, রাহুল তখন পরিবার নিয়ে খুব একটা গর্ব করত না। আর অল্পদিন পাওয়ায় তার মেধা যাচাইয়ের কোন সুযোগ আমরা পাইনি।

এরপর ১৯৯০ সালে চলে যান সোজা আমেরিকার হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইতিহাস ছেড়ে এবার ভর্তি হন অর্থনীতি বিভাগে। প্রেমে পড়েন কলম্বিয়ান বালিকা স্প্যানীশ ভাষী জুয়ানিতার। তারা এখন চুড়ান্ত পরিনয়ের অপেক্ষায়। রাহুল চার বছরের অনার্স কোর্স শেষ করলেও প্রয়োজনীয় গ্রেডের অভাবে ডিগ্রী নিতে পারেন নি। তিনি মাঝে মাঝে চুপি চুপি দাবী করেন এমফিল করার। কিন্তু সংবাদ কর্মীরা হার্ভাডের এলামনাই এসোসিয়েশন ঘেঁটে প্রাক্তন ছাত্রদের তালিকায় তার নাম পাননি। রাহুলও আর এগোননি। এ প্রসঙ্গে একটা কথা না বললেই নয়, রাজীব গান্ধীও কিন্তু ক্যামব্রিজে লেখাপড়ার শেষ পাঠটি চুকাতে পারেন নি। ইন্দিরা গান্ধীকেও অক্সফোর্ডের সমারভিল কলেজ থেকে ডিগ্রী না নিয়েই ফিরে আসতে হয়েছিল। আর কাকতালীয়ভাবে সবাই তারা তাদের প্রিয়জনকে খুজে পেয়েছিলেন ওইসব বড় বড় প্রতিষ্ঠান থেকেই। অনেকেই ব্যংগ করে বলেন, এজন্যই বুঝি বিধাতা তাদেরকে ওখানে পাঠিয়েছিলেন! এসব অসম্পূর্ন ডিগ্রী কিন্তু তাদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে ধ্বংস করতে পারেনি। নিয়মের অমোঘ ধারায় হয়তো রাহুলও সেভাবেই পার পেয়ে যাবেন।

রাহুল পুরোদমে এখন রাজনীতি শিখছেন।নেহেরু পরিবারের এই উত্তরাধিকারকেসেভাবেই পূর্ন প্রস্তুতি নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে। একদল উপদেস্টা সার্বক্ষনিক মনিটর করছেন । ইমেজ যাতে আর ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিক থেকে তারা আগের চেয়ে এখন আরো বেশী সচেতন। রাজস্থানের গভর্ণর শালেন্দ্র কুমার সিং-এর পুত্র কানিশক তাদের মধ্যে তরুন একজন। তিনি রাহুলকে উপমহাদেশের গতানুগতিক ধারার রাজনীতির বাইরে আনতে সদা তৎপর। ক্যারিশ্মাটিক নেতা বানাতে তাকে নিয়ে যান বস্তিতে, দলিত গ্রামবাসীদের সাথে রাত কাটান ইত্যাদি। এসবই হচ্ছে তাদের নব আবিস্কৃত রাজনৈতিক কৌশল।

বৈশাখের প্রথম প্রহরে শখ করে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার মত ক্যামেরা ম্যানদের সাথে বিদেশীদের বিশেষকরে সাদা চামড়াওয়ালদের নিয়ে বস্তিতে ছুটে যাওয়া কিংবা গ্রাম-দর্শন কালচার বর্তমানে বাংলাদেশে বেশ প্রকট। উদ্দেশ্য মহৎ হলে অবশ্যই দোষের নয়। গরীব মানুষদের জন্য বড় বড় কথা না বলে সত্যিকার ভাবেই কিছু একটা করা নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য, উতসাহব্যঞ্জকও। কিন্তু আসলে কি তাই?

Writer আমিনূল মোহায়মেন তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতর আলোকে স্বদেশকে বিদেশের মাটিতে ডুবানোর এরকম ভয়াবহ প্রকল খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন তার লেখা বাংলাদেশে মিডিয়ার নেতিবাচক ভূমিকাঃ প্রকৃতি, প্রভাব ও কারন প্রবন্ধে। তিনি লিখেছেন, ‘নব্বই এর দশকে বাংলাদেশে এনজিও খোলার হিড়িক পড়ে যায়। অধিকাংশ এনজিওর অর্থায়ন ঘটে বিদেশী উৎস থেকে। বিদেশ থেকে অর্থ আনার জন্য তারা বাংলাদেশের দারিদ্র, অনগ্রসরতা, ধর্মীয় কুসংস্কার - ইত্যাদিকে অতিরঞ্জিত করে বহির্বিশ্বে উপস'াপন করে। আমি এক সময় বাংলাদেশের একটি বৃহৎ এনজিওতে কাজ করতাম। হেড অফিসের একটি বিশাল ফ্লোর নিয়ে ছিল মিডিয়া ডিপার্টমেন্টের স্টুডিও। ভিডিওগ্রাফীর প্রতি আগ্রহ থাকার কারণে প্রায়ই সেখানে যেতাম। স্টুডিওতে চাটাই দিয়ে গ্রামের কুড়েঘর তৈরী করে সেখানে গ্রাম্য নারী সাজিয়ে অনেকের ইন্টারভিউ নিতে দেখেছি। এ ধরণের একটি ইন্টারভিউতে সাজানো গ্রাম্য নারীকে বর্ণনা করতে দেখেছিলাম তার উপর ফতোয়াবাজদের অত্যাচারের বানানো কাহিনী। সেই ভিডিওগুলো আবার ইংরাজীতে ডাবিং করে ফান্ড রেইজিং এর জন্য বিদেশে পাঠানো হতো। শিল্প-সাহিত্য বিশেষ করে চলচিত্রের সাথে সংশ্লিষ্টগণ দেশী-বিদেশী পুরস্কার পাবার আশায় বাংলাদেশের নেতিবাচক চিত্র ফুটিয়ে তুলে চলচিত্র তৈরী করেন। মাটির ময়নাসহ যে সকল বাংলাদেশী সিনেমা এ পর্যন- আন-র্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে তাদের সবগুলোতেই বাংলাদেশকে নেতিবাচকভাবে দিক তুলে ধরা হয়েছে। জনপ্রিয় চলচিত্র নির্মাতা ও ঔপন্যাসিক হুমায়ুন আহমেদ একবার বলেছিলেন, আমাদের দেশের চলচিত্রের জন্য বিদেশী পুরস্কার পাবার প্রধান শর্ত হচ্ছে তাতে বাংলাদেশকে দারিদ্র পীড়িত, পশ্চাদপদ ও সাম্প্রদায়িক হিসাবে দেখাতে হবে। একই কথা বলতেন আমার সিনেমাটোগ্রাফীর শিক্ষক প্রখ্যাত চলচিত্রকার মরহুম আব্দুস সামাদ। বিশাল প্রবন্ধে তিনি আরো লিখেছেন, এদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের দারিদ্র ও অনগ্রসরতা এখন একটা দর্শনীয় বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কেউ মিশরে গেলে পিরামিড দেখতে চায়, ইন্ডিয়ায় গেলে তাজমহল কিংবা বাঙ্গালোরের সিলিকন ভ্যালী দেখতে যায়। কায়রোতে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছনে কবরস্থানের উপরে বস্তি গড়ে উঠেছে। ওরা তাকে বলে মদীনাতুল মাইয়েত বা মৃতের শহর। সে দেশের সরকার ভিআইপি অতিথিকে এই শহরটি দেখাতে নিয়ে যায় না। ইন্ডিয়ায় অসংখ্য নবজাতক কন্যাশিশুকে প্রতিদিন জীবন- হত্যা করা হচ্ছে, অভাবের তাড়নায় কৃষকেরা আত্মহত্যা করছে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নিহত হচ্ছে অসংখ্য নাগরিক। তাদের নিয়ে তৈরী মিউজিয়ম বা এজাতীয় কিছু দেখাতে সে দেশের রাষ্ট্রীয় অতিথিদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় না। অথচ, আমাদের দেশে কোন ভিআইপি অতিথি এলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বস্তিতে, বাংলাদেশের দীন-হীন রূপটি দেখাতে। বাংলাদেশকে দারিদ্রের দেশ, মৌলবাদের দেশ, সাম্প্রদায়িকতার দেশ হিসাবে এরাই বিশ্বে পরিচিত করে তুলেছে।‘

এভাবেই চলছে ভদ্র কায়দায় সেলিব্রিটিদের দিয়ে আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার নামে দেশবিরোধী প্রচারনা। আয়োজন চলছে দেশকে মডার্ন কলোনাইজশেনভুক্ত করে স্থায়ীভাবে নির্ভরশীল বানানোর অদম্য প্রয়াস। ভাবতে কষ্ট লাগে ভারতের মতো যেদেশে কোটি কোটি লোক দারিদ্র্যসীমার নীচে মানবেতর জীবনযাপন করছে, তাদের কাউকেও আজ ধরে এনে বিল গেটসীয় কায়দায় বলানো হয়, আইটি খাতে বাংলাদেশের ছাত্রদেরকে লোভনীয় স্কলারশীপের ব্যবস্থা করার কথা বলবে রাহুল গান্ধী। একথা শুনে আমরা (যারা ডজন ডজন ভারতীয় ছাত্রদেরসাথে পড়াশোনা, এক সাথে চাকরি করার মাধ্যমে তাদেরকে ভাল করে জানি) শুধু নয় খোদ ভারতীয় নাগরিকরাই মুখ টিপে হাসে।আইটিতে তাদের অসামান্য উন্নতি নিঃসন্দেহে ঈর্ষার কারন, তাই বলে এ রকম বাগাড়াম্বর কথা শুনানো কি খুব বিলাসিতা নয় কি? এভাবেই কি দেশে দেশে গিয়ে আমাদের পন্ডিতজনেরা দেশের সুনাম বৃদ্ধি করছেন?


* লেখাটি দৈনিক নয়াদিগন্ত ১৫ই আগস্ট, ২০০৮ এ প্রকাশ করেছে।
http://www.dailynayadiganta.com/2008/08/15/fullnews.asp?News_ID=98504&sec=6