Thursday, October 23, 2008

কুশিক্ষা যখন উচ্চশিক্ষার পথ রুদ্ধ করে


খুব পুরোনো একটা প্রবাদবাক্য নিয়ে আমার মতো সবাই বোধ করি স্কুল জীবনে ভাব-সম্প্রসারণ লিখতেন,‘দূর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য, সর্পের মস্তকে মণি থাকলেও সে কি ভয়ংকর নহে?’এরসাথে আরো একটি যোগ না করে পারছিনা ‘গুরুজনে করো নতি, সেবা করো কায়মনে।’এই লেখাটি শুরুর দিন (অক্টোবর ২২, ২০০৮) দৈনিক কাগজে আসা দুইটি খবর উপরোক্ত দুইটা প্রবাদ বাক্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিল। জাহাংগীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে তাঁরই বিভাগের ছাত্র/ছাত্রীরা নৈতিক স্খলনজনিত কারনে জুতা-পেটা করছেন, আরেকটি হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি তাঁর বাসভবনে সর্বশেষ হামলাকারী তাঁরই প্রিয় (!) ছাত্রদের জরুরী আইনে দ্রুত গ্রেফতার করানোর জন্য পুলিশের আইজিপি থেকে শুরু করে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় পর্যন্ত হন্তদন্ত হয়ে তদবির করছেন।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, গুরুজনদের উপর হামলা আমরা এর আগে অনেক দেখেছি।এমনকি আহত ছাত্রদের দেখতে এসেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ভিসিকে নিক্ষিপ্ত বালিশ, থুথু, অকথ্য গালিগালাজ ইত্যাদি মোকাবেলা করতে হয়েছে।নিঃসন্দেহে এসব খারাপ কাজ, এর কঠোর বিচার হওয়া উচিৎ। কিন্তু এর সাথে আরো একটা বিষয় এড়ানো উচিৎ হবেনা, তাহলো কিছু কিছু শিক্ষকদের প্রতি ছাত্রদের এত ঘৃণাই বা কেন?যে ছাত্ররা আজো কম শিক্ষিত প্রাইমারী স্কুলের কোনো শিক্ষককে দেখলে অতি আদবে চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারেনা, সেই একই ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচচ ডিগ্রীধারী পন্ডিতদের দিকে কেন ধেয়ে আসে? এর জন্য শুধু কি ছাত্রদেরই দোষ দিব নাকি দূর্জন বিদ্বানদের ফ্যাসিস্ট কার্যকলাপও এসব চাপা ক্ষোভ বিস্ফোরণের একটি অন্যতম কারণ?

নীল, সাদা, হলুদ ইত্যাদি রঙে রঞ্জিত হয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক ছদ্মাবরনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা নিজেরাই নিজেদেরকে বিভক্ত করে রেখেছেন যা দুনিয়ার অন্য কোন দেশের শিক্ষকেরা শুনলে শুধু অবাকই হন না, উলটো প্রশ্ন করে বসেন, ‘এও আবার কি করে সম্ভব?’ নিষিদ্ধ না থাকা যেকোন রাজনৈতিক দলের সদস্য যে কেউই হতে পারেন, প্রচারও করতে পারেন তার নিজস্ব মতাদর্শ-এটা তার নাগরিক অধিকার। এসব কোনটাই দোষের নয়, কিন্তু সমস্যা হল যখন কিনা কেউ নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে বসে তার বেড়ে উঠা অতীতের গন্ডি ও বিশ্বাসের বাইরে আসতে পারেন না।বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারকে যদি আমি আমার প্রিয় রাজনৈতিক দলের সদর দপ্তরটি বানিয়ে ফেলি তখনই সমস্যা দেখা দেয়।সেক্ষেত্রে আমি তো আমার পদের সম্মান রাখতে পারলাম না। তবে হ্যাঁ, মিডিয়া হাতে থাকলে অনেক কিছুই সম্ভব! ঘোড়াকে যেমন আকাশে উড়ানো যায়, আবার ঈগলকেও পানিতে ডুবানো যায়।যাঁরা নিজেদেরকে বিশ্বজনীন মানবতাবাদী বলে সারাক্ষন মুখে ফেনা তোলেন, তাঁরা নিজেরা বোঝেনও না যে বিপরীতাদর্শের প্রতি তাঁদের একপেশে ফ্যাসিস্ট মনোভাবের কারনেই মানবতা সবচেয়ে বেশী ভুলন্ঠিত হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচচশিক্ষা নিতে সম্পূর্ন অযৌক্তিকভাবে মাদ্রাসা ছাত্রদেরকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। গোটা ভর্তি পদ্ধতিই যেখানে নতুন করে সাজানোর কথা শিক্ষাবিদরা বলছেন, সেখানে কি করে ভর্তি পরীক্ষার কিছুদিন আগে উচচমাধ্যমিক স্তরে বাংলা ও ইংরেজী বিষয়ে ২০০ নাম্বার করে থাকতে হবে বলে কিছু বিভাগ যোগ্যতা নির্ধারণের একটি মাপকাঠি বানায়? ছাত্রদের বৃহৎ একটি অংশের উপর কলা ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদের যেসব বিভাগসমূহ এই অবিচার করছে বা করতে যাচ্ছে সেগুলোর নাম পত্রিকায় এসেছে বাংলা, ইংরেজী, লিংগুয়েস্টিক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, অর্থনীতি, লোক প্রশাসন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং উইমেন এ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ। পাঠকেরা নিশ্চয়ই জানেন, যারা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশোনা করে ‘ও’ বা ‘এ’ লেভেলে ডিগ্রী নেয় তারাও বাংলা বা ইংরেজী বিষয়ে ২০০ নাম্বারের পরীক্ষা দেয় না।একই কায়দায় এসব ছাত্রদের উপর আপত্তিকর ওইসব শর্তসমূহ আরোপ না করায় ‘ক’ ও ‘ঘ’ ইউনিটের দায়ী ব্যক্তিদের কেউ যদি ‘দূর্জন বিদ্বান’ বলে গালমন্দ করে প্রতিরোধ করতে আসে তাদেরকে কে ঠেকাবে?

‘সব ছাত্রদের সমানভাবে দেখা উচিৎ’ এটা সম্মানিত শিক্ষক মহোদয়রা হরহামেশা বললেও অনেকের কার্যকলাপ ঠিক এর উল্টো। সর্বোচচ বিদ্যাপীঠে এমন শিক্ষকেরও প্রমাণ মিলে যাঁরা তাঁর একাংশ ছাত্রদের বিরুদ্ধে বখে যাওয়া আদু ভাই, ধাড়ি ছাত্রনেতাদের চেয়েও বেশী কথা বলেন।একটি নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশের মানুষ যখন অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন ঠিক সেই সময়ে নন-ইস্যুকে ইস্যু বানানোর মতলব, আর যাই হোক, নিশ্চয়ই ভাল বলা যাবেনা। তাছাড়া বাংলাদেশ সরকার অনূমোদিত যেকোন পদ্ধতিকে অস্বীকার করাতো আইন অমান্যেরই শামিল।ভর্তি পরীক্ষা যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ নির্ধারনের মাপকাঠি হয় তবে ঢাকা ভার্সিটির উচিৎ বুয়েটের অবিতর্কিত পদ্ধতি সম্মন্ধে জ্ঞানলাভ করা। বিআইটি বা বর্তমানে অন্যান্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় সমূহও মোটামুটি একই নিয়ম কঠোরভাবে অনুসরন করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে।দেশের সব ছাত্রদেরকে সমানভাবে মূল্যায়ন করায় এনিয়ে আজো তাঁদের বিরুদ্ধে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেনি। তাছাড়া কোন কোন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রদের ব্যক্তিগত রুঢ আচরনের অভিযোগ থাকলেও বুয়েটের শিক্ষকেরা কোন সময়েই নিজেদেরকে লাল, সাদা, কালো, নীল, হলুদ ইত্যাদি আবরনে বৃত্তাবদ্ধ করে রাখেন নি।বলা বাহুল্য, এজন্যই বোধ হয় তাঁদেরকে কখনো নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য কোথাও দৌড়াতেও হয়নি।

কমিউনিজম ও একনায়কতান্ত্রিক দেশ ব্যতিরিকে যেকোন দেশেই শিক্ষাব্যবস্থার একাধিক মডেল বিদ্যমান। বহুমাত্রিক সংস্কৃতি ও বিশ্বাসকে দমন নয়, বরঞ্চ উৎসাহিত করাই হল গনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার স্বীকৃত একটি মৌলিক উপাদান। নিজস্ব কালচারকে টিকিয়ে রাখতে জাতিসংঘের মত প্রতিষ্ঠানও বিভিন্ন কমিউনিটিতে নিরন্তরভাবে প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে । তাদের জনপ্রিয় একটি শ্লোগান হল, ‘Celebrate your own festival (নিজের উৎসব নিয়ে আনন্দ করো)’। আমেরিকা ও কানাডাতে ক্যাথলিক স্কুল, জুইশ স্কুল, ফ্রেঞ্চ স্কুল, ইসলামিক স্কুল এমনকি তামিল স্কুলও দেখেছি। সেসব স্কুল থেকে পাশ করা গ্রাজুয়েটদের শর্তের মারপ্যাঁচ দিয়ে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ই এমন কোন হিংসাত্মক সিদ্ধান্ত নেয়না। আমেরিকার যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি মাস্টার্স করেছি, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম থেকে শুরু করে এর উদ্ধেশ্য পর্যন্ত প্রসপেক্টাসে স্পষ্টভাবে বিধৃত করা হয়েছে খ্রীস্টান আদর্শ প্রচারের মহৎ ব্রতের কথা।এমনকি প্রতিটি ক্লাসে ক্রুশবিদ্ধ যীশুর প্রতিকৃতি শোভা পেলেও কর্তৃপক্ষ কিছু মুসলিম ছাত্র/ছাত্রীদের জন্য সুন্দর একটি মসজিদের ব্যবস্থা করতে ভোলেননি।মাল্টি কালচারিজম উৎসাহিত করতে কানাডায় বছরে একটি দিনকে ‘ইন্টারন্যাশনাল ভিলেজ ফেস্টিভ্যাল’ বলেও অভিহিত করা হয়।

বাংলাদেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস অথবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল উদ্ধেশ্যের দিকে না তাকিয়ে আমরা উক্ত বিভাগসমূহের সম্মানিত শিক্ষকদের মোটিভের দিকে তাকাতে পারি।ধরে নিলাম, তাঁরা তাঁদের বিভাগসমূহকে আরো আধুনিকীকরন করতে চাচ্ছেন। তার মানেটা কি? সেটি তো হওয়া উচিৎ ছিল পদ্ধতি আরো সহজ করে বেশী ছাত্রদেরকে কাছে টেনে নিয়ে আসা।কথা ছিল, সনাতনী গৎবাঁধা শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে ব্যবহারিক উন্নত শিক্ষায় ছাত্রদেরকে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করা।পক্ষে কোন্‌‌ দেশের উদাহরন তাঁরা টানতে চাচ্ছেন?সেসব দেশের মধ্যে বর্তমানে একমাত্র চীন ছাড়া তো হারাধনের অবশিষ্ট আর কেউ নেই। সবাই আজ বাস্তবতা স্বীকার করে ভিন্ন পদ্ধতির সৌন্দর্য্য শিখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ সেন্টারে রাতদিন খাটছেন।আর আমাদের দেশে চলছে এর উল্টোটা! কি বিচিত্র পৃথিবী!

এবার দেখি, বাংলাদেশের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইন মানুষের এই মৌলিক অধিকারটি নিয়ে কি বলে। বাংলাদেশের সংবিধানে উল্লেখ রয়েছেঃ
‘২৮(১) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না। (৩) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোন বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোন নাগরিককে কোনরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না। ২৯(১) প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে। (২) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না।’
আর জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদ বা ‘দ্যা ইউনিভার্স্যাল ডিক্ল্যারেশন অব হিউম্যান রাইটস’-র ২৬ নং অনুচ্ছেদে ১ থেকে ৩ নং ধারায় এভাবে বলা হয়েছেঃ
Everyone has the right to education. Education shall be free, at least in the elementary and fundamental stages. Elementary education shall be compulsory. Technical and professional education shall be made generally available and higher education shall be equally accessible to all on the basis of merit. (অর্থাৎ, লেখাপড়া শেখা প্রত্যকেরই অধিকার।এটা হতে হবে বিনা পয়সায়, অন্ততপক্ষে প্রাইমারী শিক্ষাসমূহ। টেকনিক্যাল এবং পেশাগত শিক্ষা অবশ্যই সর্বসাধারনের জন্য উন্মুক্ত হতে হবে।আর উচচশিক্ষার দুয়ার সবার জন্য সমানভাবে মেধার ভিত্তিতেই নির্ণিত হবে।)
Education shall be directed to the full development of the human personality and to the strengthening of respect for human rights and fundamental freedoms. It shall promote understanding, tolerance and friendship among all nations, racial or religious groups, and shall further the activities of the United Nations for the maintenance of peace. (অর্থাৎ, শিক্ষা মানুষের ব্যক্তিত্ত্ব উন্নত করনের নির্দেশনা দিবে এবং সম্মানের ভিত্তিতে মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা মজবুত করবে।প্রত্যকে দেশ, জাতি বা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষা পারস্পরিক বোঝাপোড়া, সহমর্মিতা এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে উৎসাহ যোগাবে। জাতিসংঘের শান্তি বজায় রাখা কর্মসূচীতেও এটা উৎসাহ যোগাবে।)
Parents have a prior right to choose the kind of education that shall be given to their children. (অর্থাৎ, ছেলেমেয়েদের যেকোন ধরনের শিক্ষা প্রদানের অধিকার পিতা-মাতাদের রয়েছে।)

পরিশেষে বলব, প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে এমন মানুষ নিশ্চয়ই লুক্কায়িত আছে, যারা চায় না বাংলাদেশের মানুষ শিক্ষা-দীক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে যাক। সারা দেশের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন স্পর্শকাতর বিষয়সমূহ উস্কে দিয়ে হিংসা, হানাহানি ছড়িয়ে এরা হয়তো ছাত্রদেরকে সারাক্ষন ব্যস্ত রাখতে চায়। আর যেকোন অন্যায়, জুলুমের পরিনতি যে কখনো ভাল ফল বয়ে আনেনা পাকিস্তানের স্বৈরশাসক মোশাররফের সাম্প্রতিক মাদ্রাসাবিরোধী জংগীদমন অভিযান তার বড় প্রমান। একই প্রক্রিয়ায় লালন-ভাস্কর্য, মাদ্রাসা ছাত্ররোধ ভর্তি ইত্যাদি ইস্যু সুপরিকল্পিতভাবে তৈরী করে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে ক্ষেপিয়ে দিয়ে গ্লোবাল ষড়যন্ত্রকারীরা আন্তর্জাতিক অংগনে বাংলাদেশকে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-র অংশীদার ও জংগী দেশ বানাতে মরিয়া হয়ে উঠছে। মাননীয় ভিসি ডঃ ফায়েজ যেমন তাঁর বাসা আক্রমনকারী দুস্কৃতকারীদেরকে আচ্ছামত শাস্তি দেওয়ানোর জন্য অস্থির হয়েছেন, ঠিক তেমনি তাঁর আরো দ্বিগুন-তিনগুন অস্থির হওয়া উচিৎ যেন একদল ছাত্র/ছাত্রীর মহামুল্যবান জীবন ও গোটা দেশ নিয়ে কেউ ছিনিমিনি না খেলে। ব্যক্তিগতভাবে আমার সারা গোষ্ঠীর কেউ-ই মাদ্রাসায় লেখাপড়া না করলেও এই অবিচারের বিরুদ্ধে যেমন কলম ধরে প্রতিবাদ জানাতে বাধ্য হচ্ছি, আর যাঁরা এর ভুক্তভোগী তাদের মনোবেদনা আঁচ করতে সংশ্লিষ্টদের খুব বেশী কষ্ট হওয়ার কথা নয়। গায়ের জোরে এরকম উদ্ভট সিদ্ধান্ত জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে চালাকি করে প্রকারান্তরে নিজেদের বুদ্ধির দীনতা প্রকাশ করার মাঝে কোন কল্যান নেই।‘করো নতি’ যাঁদের প্রাপ্য ছিল,তার বদলে সেসব উচচশিক্ষিত পন্ডিত শিক্ষকদেরকে যেন ছাত্ররা ‘ভয়ংকর’ বা ‘দূর্জন বিদ্বান’ আখ্যায়িত করে এড়িয়ে না চলে (ঠিক যেমনটি আমরা ‘মণি’ থাকা সত্ত্বেও সর্পকে এড়িয়ে চলি) সেদিকে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক দৃষ্টি দেওয়া উচিৎ।

Friday, October 10, 2008

ফিনিক্স পাখি এবং দুই নেত্রী



ফিনিক্স পাখির সাথে দুই নেত্রীর তুলনা করা হচ্ছে। প্রাচীন গ্রীক পূরা কাহিনী অনুসারে ফিনিক্স হল এমনই পবিত্র ‘অগ্নি-পাখি’ যার জীবন চক্র আবর্তিত হয় হাজার বছর ধরে। মনোলোভা স্বর্ণের লেজ এবং লাল, গোলাপী ও নীল রঙের পালক দ্বারা আবৃত ময়ুর সদৃশ এই পাখির প্রকৃত অর্থে কোন মৃত্যু নেই। হাজার বছর পূর্তি অর্থাৎ যমদূত আসার ঠিক আগেই দারুচিনি দিয়ে ফিনিক্স নিজের বাসা নিজেই বানিয়ে তা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। আর নির্মমভাবে দগ্ধীভূত এই পাখি ও তার বাসার ভস্ম থেকেই জন্ম নেয় নতুন ডিম্বের। প্রাণ পায় নব জীবনের, শুরু হয় আবারো জাতিশ্বর ফিনিক্সের অবিনাশী যাত্রা। বেঁচে থাকে পূর্ব জনমের আয়ুস্কালের মতই। কাহিনীমতে, ফিনিক্স পাখিকে হিংসুকেরা আঘাত করলে এর পালক থেকেও জন্ম নেয় নতুন প্রাণ।এদের চোখের পানিও বদলে দিতে পারে কারো জীবন। অগ্নি ও পবিত্রতার বদৌলতে এরা মৃত্যু পথযাত্রীদেরও সাময়িক জীবন দেয়ার ক্ষমতা রাখে।

প্রবীন রাস্ট্রবিজ্ঞানী তালুকদার মনিরুজ্জামান দুই নেত্রীকে কাল্পনিক অসাধারন ক্ষমতাধর এই পাখির সাথে তুলনা করেছেন। তাঁর কাছে নিশ্চয়ই যুক্তি রয়েছে। এই উপমহাদেশের কথাই ধরুন। ইন্দিরা গান্ধীর ভস্ম থেকে জন্ম নিয়েছে নতুন ফিনিক্স রাজীবের। রাজীবের পালক থেকে সোনিয়া, ‘অগ্নিমুখ’ থেকে এল রাহুল। জুলফিকার ভুট্টোর ‘গলার রশি’ ধরে থেকে জন্ম হলো ফিনিক্স পাখি বেনজীরের। তাঁর রক্ত ডিঙিয়ে চলে এল আসিফ জারদারী। জন্ম হল নতুন ফিনিক্স বিলাওয়ালের। বাপের সাথে মিলিয়ে নাম ছিল ‘বিলাওয়াল জারদারী’। কিন্তু ফিনিক্স পাকাপোক্ত করে নামও পালটে রাখা হল ‘বিলাওয়াল ভুট্টো’। শ্রীলংকার ফিনিক্সজনক হলেন সলোমন বন্দরনায়েকে। শত্রুর আঘাতে তাঁর ‘পবিত্রাগ্নি’ থেকে চলে এলেন একসাথে স্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে এবং মেয়ে চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গে। বাংলাদেশের অতীত ও ভবিষ্যত ফিনিক্স পাখিদের কথা সবার সামনে পরিস্কার থাকায় আলোচনা নাইবা করলাম।

ইতিহাসে সূত্র ধরে আপনাদের উপরো আঘাত এল । দুই দলেই জন্ম নিল কিছু ইঁদুরের। কেঁপে ঊঠছিলেন আপনারা। ভাবতেও পারেননি এত্থেকে আবার জেগে উঠবেন। কিন্তু ওই যে ফিনিক্স পাখি, আঘাত এলে আবার নতুন করে গজায়! আপনাদেরকে নিঃশেষ করতে পারেনি। তরবারীর নীচে মাথা রেখে কলমযোদ্ধারা জনতাকে জাগিয়ে দিয়ে জিতিয়ে দিল। বাংলার মানুষেরা প্রানভরে ভালবাসল। কিন্তু আপনারা কি নতুন করে জন্ম নিয়ে জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে নিতে পারবেন? সমগ্র দেশের নেত্রী হয়েও বিদেশে এসে সারাক্ষন যখন ‘দল’, ‘দল’ করেন, যারা বিদেশে বসে ‘দেশ’,’দেশ’ করে তাঁরা বড্ড অসহায় হয়ে পড়ে। আর ফখরুদ্দিন সাহেব তো আপনাদের দুইজনকে পেঁচিয়ে জাতিসংঘের সাধারন সভায় ২৬ সেপ্টেম্বরে গর্বের সাথে স্বদেশ সম্মন্ধে বললেন, ‘দশকের পর দশক ধরে চলে আসা দুর্নীতি দেশের গনতন্ত্র ও অর্থনীতিকে গ্রাস করেছিল’। গতবছর বলেছিলেন, ‘বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশে দুর্নীতির দুষ্টচক্রে গণতন্ত্রের উপাদানগুলো আবদ্ধ ছিল’। নিজের দেশ সম্মন্ধে সেই দেশেরই শীর্ষনেতৃবৃন্দের এরকম ‘নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মার্কা’ টাইপের কথাবার্তা পত্রিকায় প্রকাশ হয়ে পড়ায় বিদেশীদের নিকট থেকে মুখ লুকাবার জায়গা খুঁজি আমরা। ‘কার আমলে বেশী দূর্নীতি’ এ নিয়ে ঝগড়া বানরের তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে এক লাফ উপরে আর দুই লাফ নীচে নামাতেই জনম শেষ হয়ে যাবে, সমাধান মিলবেনা। যাহোক, পারবেন কি দলীয় গন্ডীর উর্ধ্বে উঠে মনটাকে আকাশের মত উদার করে সব মানুষকে ভালবাসতে? দলতো অনেক করলেন, দেখলেনও অনেক।জেনে গেলেন দৃশ্য-অদৃশ্য শক্তির নানান খেলা। আরো জানলেন, কারা আপনাদের সত্যি সত্যি ভালবাসে আর কারা আপনাদেরকে ভালবেসে চালাকি করে। জনতার কাতাড়ে না গিয়ে কোন্‌ শেকড়হীনেরা নিজেদের অস্তিত্ব বা গুরুত্ব বাড়াতে আপনাদের ব্যবহার করে? ঘৃণা ও বিভক্তির রাজনীতি করে। তাই বলে বলছিনা দল ছেড়ে দিতে। দলই আপনাদের পরিচয় বাড়িয়ে দিয়েছে, সত্য। বলছি মনটাকে অনেক বড় করতে।

ধরুন, আপনি ঢাকা থেকে বিমানে চড়ে বিদেশ যাত্রা করছেন। জিয়া থেকে একটু উপরে ঊঠেই হয়তো আপনি খোঁজার চেষ্টা করেন আপনার প্রাণপ্রিয় রাজনৈতিক দলের নয়াপল্টন বা বঙ্গবন্ধু এভিনিঊয়ের হেড অফিস। আর একটু উপরে উঠে দেখতে চান ঢাকা শহর, পরে খুঁজে ফেরেন বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষা আপনার প্রিয় মেগাসিটিকে। এক সময় হয়তো হাতড়ে খোঁজার চেষ্টা করেন সমগ্র বাংলাদেশটাকেই। সেটিও একসময় দৃষ্টির সীমানায় হারিয়ে যায়। এবার খোঁজেন উপমহাদেশ, তারপর এশিয়া। পার হয়ে যান একসময় প্রশান্ত মহাসাগর, আটলান্টিক মহাসাগর ইত্যাদি। এই আপনাকেই যদি মহাকাশের অভিযাত্রী বানিয়ে ছেড়ে দেয়া হয় মহাশুন্যের কোন গ্যালাক্সিতে, এবার আপনি দেশ মহাদেশের ঊর্ধ্বে উঠে খুঁজতে চাইবেন সমগ্র পৃথিবীটাকে।

ওবামা ও ম্যাককেইনের নির্বাচনী প্রচারনায় সারা আমেরিকানদের সাথে নিয়ে একসাথে কাজ করবার অভিপ্রায়ের কথা মনে পড়ছে। তাঁদের কথা আপনাদের মুখ দিয়ে বলায়েই না হয় আজকের আলোচনা শেষ করব।

কেন এমন হলো?
অন্তর্নিহিত রহস্য পূর্বে আঁচ করতে না পারলেও এটি ছিল গতানুগতিক হেঁয়ালী, একরোখা, পশ্চাদমূখী ও স্মরণশক্তিহীন বা ‘পরিবর্তনশীল দুনিয়ায় অপরিবর্তনশীল’ রাজনীতির লৌহ কপাটে আত্ম-উপলদ্ধির করাঘাত। সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন ও মেরুদন্ডহীন মনোবৃত্তির প্রতি প্রচন্ড বিদ্রোহ। দলীয় শৃংখলে আবদ্ধ হিংস্র ও বর্বর মানুষ পেটানো রাজনীতির বিপরীতে অমিয় সুবাতাসে দেশটাকে শান্তি ও উন্নয়নের মরু উদ্যানে পরিনত করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। স্তাবকদের শঠতা, মিথ্যা কুহেলিকা ছিন্ন করে প্রখর দৃষ্টি নিয়ে শত্রুকে চিনে সম্মুখপানে চলার প্রতিযোগিতা। মোদ্দাকথা, ব্যারিস্টার রফিকের ভাষায় ‘চোর-বাটপারদের’ চিরতরে কবর দেয়ার সাহসী চেতনাই যেন হয় ওয়ান ইলেভেনের শিক্ষা।

দেশের মানুষই এত্থেকে কিন্তু আপনাদেরকে উদ্ধার করল, দল করেনি। সাধারন মানুষ নামের অজেয় শক্তি এই মূহুর্তে অনেককেই মাইনাস করে দিল, আপনাদেরকে করেনি। সাথে আরো একটা বিষয় পরিস্কার হয়ে গেছে। সেটা হলো প্রতিটা রাজনৈতিক দলই এদেশের মাটি থেকেই উৎসরিত। প্রতিপক্ষ দলসমূকে কথায় কথায় ‘অমুক দেশের দালাল’, ‘তমুক দেশের আলাল’ বলে যে গালমন্দ করেন, কই তাঁরা তো কেউই আপনাদের উদ্ধার করতে এল না! বরঞ্চ দৃশ্য-অদৃশ্য বিনি সূতোর মালায় তাঁরা কি করেছে তা তো সাব-জেলে বসেই জেনেছেন নিশ্চয়ই। এদেশের সাধারন জনতাই আপনাদের উদ্ধার করেছে। দয়া করে তাদের ভালবাসাকে আর ফিরাবেন না।

দুই নেত্রীর মুখ চাওয়া-চাওয়ির কথা বলতেই ‘অসভ্য’ কথা বলার মহড়া আবার শুরু হয়ে গেছে। সংসদের বাইরে ‘পলিসি সামিট’ এই মূহুর্তে প্রয়োজন রয়েছে কিনা সে প্রসংগ বাদ দিয়েই বলতে পারি যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা গলদঘর্ম হয়ে যাবেন কিন্তু এরকম কোন সুশীল দেশ খুঁজে পাবেন না যেদেশে প্রতিদ্বন্দ্বী দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের মধ্যে ‘হ্যান্ডশ্যাক’ পর্যন্ত হারাম। কংগ্রেস-বিজেপি, পিপিপি-পিএমএল, মালয়েশিয়ায় বিএন-কাআদিলান রাকায়েতসহ দুনিয়ার সাপে নেউলে সম্পর্ক অন্যান্য দলের দিকে তাকালেও হিসাব মেলেনা। কানাডার কনজারভেটিভ-লিবারেলদের মধ্যকার উত্তপ্ত বাক্যবান দেখলে বাংলাদেশের সংসদের দৃশ্য সহজেই চোখে ভাসে। অথচ, পার্লামেন্ট ভাঙার আগে প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারের বাসভবনে আলোচনা করতে এসে বিরোধী দল নেতা স্টিফেন ডিওনের হাস্যরসাত্মক ছবি আমাদের জন্মভূমিতে কল্পনায়ও কেন পাইনা?

এমন তো হওয়ার কথা ছিলনা!
অতিথি আপ্যায়ন, এমনকি শত্রুকেও পাশে স্থান দেওয়ার হাজার বছরের সমৃদ্ধ কালচারের দেশে কোন্‌ স্তাবকেরা আপনাদেরকে মাটি নয় যেন ‘ধাতব পদার্থের তৈরী’ অতি দানবীয় রূপে রুপান্তরিত করে দিলো? অথচ, বার বার প্রধানমন্ত্রী ও মানুষের দৃষ্টিতে লৌহ মানবী হয়েও চল্লিশোর্ধ ছেলেকে জড়িয়ে পাগলের মত চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দেন, নবজাতক নাতী-নাতনীদের দেখার জন্য বা সদ্য প্রসূতা মেয়েকে অপত্য স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য পাগল হয়ে যান! এর উত্তর আগে জানলেও এখন বোধ করি আর অজানা নেই। আব্দুলদের মাইনাস করার মত আপনাদেরকে এই বন্দনা সৃষ্টিকারীদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। লন্ড্রী করা সাদা জামা-কাপড় পড়ে এসব মিডিয়া বাঘদের সুফী সুফী কথাবার্তা জাতি অনেক শুনেছে। এবার লুটেরা বা ‘মোর ক্যাথলিক দ্যান পোপ’ নয়, ইতিবাচক মনোবৃত্তির সত্যিকার দেশপ্রেমিকদের জাতি দেখতে চায়। প্রতিদ্বন্দ্বীতার চরম মূহুর্তে মাত্র চার হাজার মানুষের প্রানহানি নাইন ইলেভেনের সাত বছর পূর্তি উপলক্ষে রাজনীতি বাইরে রেখে ওবামা ম্যাককেইন এক মঞ্চে উঠতে পারলেও, লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগের দিনটিতেও আপনারা এক হতে পারেন না।

আপনারা কি পারবেন না ভবিষ্যত প্রজন্মের দিকে চেয়ে শুধু সামনের দিকের কথাই বলতে? অনেকযুগ তো পেরিয়ে এলেন। শুধু পেছনের দিনের কথা বলে জাতি কি কিছু পেয়েছে? চিরদিন বিভক্তি আর ঘৃণা নিয়ে কোন জাতি বাঁচতে পারে? কোন দেশের রাজনীতিই ‘অতীত’ নামক কুপমুন্ডকতা এভাবে জগদ্দল পাথরের মত ঘাড়ে চেপে বসে জাতিকে যুগের পর যুগ উস্কে দেয়না। আমেরিকায় ডেমোক্রেট রিপাবলিকান মোটামুটি সব প্রেসিডেন্টের ঝুলিতেই একাধিক কেলেংকারীর কলংক থাকলেও সমালোচনার তীর ঠিক আগেরজনের বেশী অতিক্রম করেনা। আর আমাদের দেশে আগেরজন তো দূরে থাক অশ্রাব্য বাক্যবানের শূল কারো জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে নিয়েও চলে। পুরাতন ফিনিক্সদের স্ব-স্ব অবস্থানে রেখে দিন, তাঁদের নিয়ে আর রাজনীতি করবেন না। এ বছর ৪ এপ্রিল আমেরিকার কালোদের প্রবাদপুরুষ মার্টিন লুথার কিং-এর ৪০ তম হত্যা দিবস উপলক্ষ্যে প্রার্থনা সভায় নিজের বাবার নির্মম হত্যাকান্ড স্মরন করে তার ছেলে চল্লিশ বছর পিছনে ফিরিয়ে না তাকিয়ে চল্লিশ বছর সামনের দিকে তাকাতে আমেরিকাবাসীদের আহবান জানিয়েছেন। বলেছেন, ‘পুরোন কথা তুলে এনে কি লাভ, চল্লিশ বছর পর আমরা দুনিয়াতে কি দিব তাই নিয়েই ভাবুন।‘

কি চাই এবার?
তাই বলছিলাম, আশার কথা শোনান। জাতিকে ভিশন ও বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা দেখান। রূপকথার গল্পের ফুলঝড়ি বা দুয়োরানী-সুয়োরানীর শোকগাঁথা কল্পকাহিনী নয়। সশ্রদ্ধা রেখেই বলছি, আপনাদের কেউ বলছেন ২০১৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে বিশ্বে একটি মধ্যআয়ের দেশে পরিনত করবেন, অত সালের মধ্যে নিরক্ষতামুক্ত দেশ উপহার দিবেন, ১০ টাকা কেজি চাল খাওয়াবেন ইত্যাদি।কিন্তু কিভাবে? সেটি নিয়ে ন্যুনতম কোন গবেষনা তো আপনাদের দলের ওয়েবসাইট বা কোথাও চোখে পড়ল না!

সবার আগে ঠিক করুন ‘স্ট্র্যাটেজিস্ট’ বা ‘কৌশলী’। বাংলার মানুষদের মনন , ঐতিহ্য ও মাটির গন্ধে মিশে আছে এবং গ্লোবাল পলিটিক্সের বর্তমান ধারা নখদর্পনে এমন আধুনিক এবং বিজ্ঞানমনস্ক মানুষদের নিয়ে গড়ে তুলুন ‘থিংক ট্যাংক’। আগে থেকে আপনাদের সেসব আছে কিনা জানিনা। থাকলে তা পালটিয়ে ফেলুন। কারন, তাঁরা যা দেবার, জাতিকে তা দিয়ে ফেলেছেন। রাস্তায় শবের উপর বিভীৎস নৃত্য ও ওয়ান ইলেভেনের ধারনা কয়েক বছর আগে কানাডিয়ান আইনজীবি উইলিয়াম স্লোন জানলেও আপনারা কিন্তু তা জানেননি। দেশজ থিংক ট্যাংক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ডালপালা আপনার পাশে থাকলে আগে থেকেই ইংগিত পেতেন। ইউএস ডিপার্টমেন্ট স্টেটের পলিসি ও প্ল্যানিং ডিরেক্টর রিচার্ড হায়াস এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বলেন, ‘Of many influenc on US foreign policy formation, the role of think tank is among the most important and least appreciated’।
ম্যাককেইনের দলীয় সম্মেলনে দেয়া ভাষন দিয়ে আজকের আলোচনা শেষ করার ওয়াদা প্রথমেই আপনাদেরকে দিয়েছিলাম। ওবামার কথাটাও এমনি ছিল। এবার সেটি কল্পনায় আপনাদের দুজনের স্ব স্ব মুখ থেকে পৃথকভাবে না হয় শুনে নেই! ‘বাংলাদেশীরা এক দল অন্য দলের বিরুদ্ধে আর বিষোদগার দেখতে চায় না। দেশের দুই দলের সদস্যদের সাথেই কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে। আমাদের মূল সমস্যাটা কোথায় তা আমি জানি। আর এও জানি নিরপেক্ষভাবে দলের উর্ধ্বে ঊঠে কিভাবে এর সমাধান করতে হয়। আসুন, আমরা সব দলের মধ্যকার ভাল ভাল ধারনাগুলো কাজে লাগাই। আমরা সবাই এক স্রষ্টার বান্দা, সবাই বাংগালী।এই বাংলাদেশের জন্যই আমি যুদ্ধ করেছি। আর এবার আমি ঠিক আপনার (অর্থাত দেশের মানুষের) জন্যই লড়ব’।

Saturday, October 4, 2008

শুরু হলো পথ চলা

শরতের শিশির ভেজা আজকের সকালের আকাশও মেঘহীন। ম্যাপল ও পাইন গাছের ফাঁক দিয়ে ঝকঝকে উত্তাপহীন এক ফালি সরু রোদ ওর চোখমুখে এসে চিকচিক করছে। ঠিক সময়ে আসা স্কুল বাসের সামনে ওর সমবয়সী অনেকের সাথেই পরিচয় করিয়ে দিলাম। শক্ত করে ধরে রাখা কচি হাতটা ছেড়ে দিতেই বুকের ভেতর কোথায় যেন খচখচ করে উঠল। ওর মা এ পর্যন্ত তিনবার চোখ মুছেছে। ভেতর থেকে বলা হল জুনিয়র কিন্ডার গার্টেন স্টুডেন্টরা আগে উঠবে। লাইনে দাঁড় করিয়ে রেখে সাদা মহিলা ড্রাইভারকে বললাম, ‘হার নেইম ইজ সামারাহ্‌, শি ইজ এ ব্র্যান্ড নিউ জে.কে স্টুডেন্ট’।

হাঁটি হাঁটি পা পা করে সামারাহ্‌ বেড়ে উঠছে। আজ ওর জীবনের প্রথম শিক্ষালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু। সপ্তাহ খানেক ধরে উত্তেজনায় ছটফট করছে সে। যেদিন স্কুলব্যাগ কিনে দিলাম এক মূহুর্তের জন্যও কাঁধ থেকে সরেনি। আয়নার সামনে গিয়ে বারেবারে দাঁড়ায়। এপাশ ওপাশ ঘুরে ফিরে দেখে। অনাবিল আনন্দ ও উদ্দীপনায় রাতে ঘুমাতেও পারেনি। ব্যাগের ভিতর কি কি ভরবে, পানির বোতলটা কোন পাশে থাকবে, খাবারইবা কিভাবে রাখবে, এই ব্যাগের সাথে ক্লাসমেটের আর কারো ব্যাগ যদি মিলে যায় তবে চিনবে কেমনে, টিচারইবা ব্যাগটি দেখে কি বলবে, এরকম কত যে নিষ্পাপ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছি আমি! বিরক্ত হইনা। আমার অফিস-ব্যাগ যেইখানে রাখি ঠিক তার পাশেই ওর স্কুল-ব্যাগটা রেখে স্থির নয়নে অবলোকন করে বারবার।

ক’দিন আগে বাবা ও ছেলেকে নিয়ে চমৎকার একটা এটাচমেন্ট ই-মেইলে কে যেন পাঠিয়েছে।

বারান্দার রেলিং-এর উপরে একটি কাককে দেখিয়ে বাবা তাঁর তরুন ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘মাই ডিয়ার সান, বলতো ওটা কি?’
ছেলের সহজ উত্তর, ‘কাক, বাবা’
একই প্রশ্ন আবারো, ‘প্রিয় বৎস, ওইটার নাম কি?’
‘বললাম তো কাক, বাবা।‘
বাবা আবার জিজ্ঞেস করেন, ‘কি নাম পাখিটার?’
‘তুমি কি শুনছো না? বললাম তো কাক’
আবারো, ‘পাখিটার নাম কি যেন?’
পিতার প্রতি ছেলের এবার বিরুক্তি চরমে। বলে, ‘তোমাকে আমি আর কতবার বলব, এটা কাক, এটা কাক, কাক, কাক, কাক, কা...ক, কা....ক, কা........’

বাবা এবার ছেলেকে ডাকেন। বেডরুমে আদরের ছেলেকে নিয়ে গিয়ে তাঁর পুরোনো দিনের ডায়েরীর পাতা উল্টিয়ে দেখান। ওর বয়স যখন তিন বছর, বারান্দার ঠিক সেই স্থানটিতেই একটি কাক বসেছিল।

ছেলে আজকের মতই পিতার কাছে জানতে চেয়েছিল ‘ওইটা কি, বাবা?’
‘কাক, মাই ডিয়ার সান’, বাবার উত্তর।
ছেলে বাবাকে বারবার একই প্রশ্ন করে চলে। একবার, দুইবার, তিনবার নয়, ছাব্বিশ বার। বিরুক্তিহীনভাবে বাবা
প্রতিবারই ছেলের প্রশ্নের উত্তর অবলীলায় সঠিকটাই দিয়েছেন। শুধু তাই নয় প্রতিবারই ছেলেকে কোলে তুলে গালে একটি করে চুমোও।
বাবা আজ ডায়েরীতে লাল কালি দিয়ে বড় বড় করে লিখলেন, ‘এই রিটায়ার্ড বয়সে বিশ বছরের ছেলে তাঁর সেই প্রশ্নের উত্তর তিনবারও দিতে পারল না’।

আমি সামারাহ্‌র দিকে তাকিয়ে ওর মত করে ভাবার চেষ্টা করি। চুপচাপ ওর কান্ডগুলো পরখ করি।
‘বাবা, আমি কিন্তু অনেক বড় হয়ে গেছি’।
জিজ্ঞেস করি, ‘কত বড় হয়েছো, মা? আমার সমান?’
‘না, তোমার চেয়ে একটু ছোট। আমি তো আর বেবি না, আমি হলাম বিগ গার্ল, সাওদা হল বেবি’। ঈশারা করে ওর এক বছর বয়সের বোন সাওদাকে দেখায়।

স্কুল বাসে চড়ে বিদ্যালয়ে যাওয়ার কল্পনা করছে কার্টুন বোঝার পর থেকেই। ‘আমি কিন্তু তোমার গাড়ীতে চড়ে যাব না। বাসার সামনে যে স্কুলবাসটা আসে, ওইটাতেই যাব। আর হ্যাঁ, বাসের ভিতর থেকে তোমাদেরকে ‘বাই’ দিব। তোমরা কিন্তু আমার সাথে আসবা না। ঠিক আছে।‘
আমি বলি, ‘ঠিক আছে। তুমি তো আমার বড় মেয়ে!’
‘আর শোনো, তোমরা আমার জন্য ওয়েট করবা। স্কুল থেকে যখন ফিরব, তখনি একসাথে বাসায় আসব, তার আগে না কিন্তু, ও.কে। আচ্ছা, আমার জন্য তোমাদের মন খারাপ হবে না? সাওদা তো আমাকে মিস করবে’।পাকামী করে আরো বলে, ‘কিন্তু কি আর করা! আমাকে তো স্কুলে যেতেই হবে। তাই না?’

এদেশে চার বছর বয়স থেকে জুনিয়র কিন্ডার গার্টেন স্কুলে যাওয়ার নিয়ম। বছরে মোট দুইটি স্কুল সেশন। শরৎ (Fall) শুরু হয় সেপ্টেম্বর থেকে আর শীতেরটা (Winter) শুরু জানুয়ারী । গ্রীষ্মে (Summer) না গেলেও চলে। জুনিয়র কিন্ডার গার্টেনে নতুনদের ভর্তি হয় সেপ্টেম্বরের শুরুতে। জন্ম তারিখ যদি সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের শেষদিনেরও কোন এক দিনের মধ্যে পরে, তবুও সে ওই সেশন ধরতে পারবে, যদিও তার বয়স চার বছরের কম। মাত্র ছয়দিনের জন্য সামারাহ্‌কে পরের সেশন থেকে যেতে হচ্ছে। অবশ্যি পাশের ইসলামিক সেন্টারে আমরা ওকে আগেই দিয়েছি। আছর থেকে মাগরিব পর্যন্ত প্রায় দুই ঘন্টা করে সপ্তাহে চারদিন আরবী শেখে। বাংলাদেশী একজন ছাত্রও নাই, উপমহাদেশ ও মধ্যপ্রাচ্যের শিশুরাই ওর ফ্রেন্ড। প্রথম দিকে আশপাশে থাকতে চাইতাম।‘পার্সোনালিটি’তে সম্ভবত খুব আঘাত লাগত। ‘বড়’ দাবী করে আমার প্রস্থান নিশ্চিত হয়ে তবেই ও ওস্তাদের কাছে ফিরত।

আমি আমার শৈশবে সাড়ে চার বছর বয়সের জীবনের স্মৃতি হাতড়াতে থাকি। এমন অনুভূতি কি হয়েছিল? ফার্স্ট ওয়ার্ল্ডের সিটিজেন মেয়ের তৃতীয় বিশ্বের নাগরিক বাবার জীবনে এরকম অনুভূতি কি হয়েছিল? না হয়নি। গ্রামে আমাদের বাড়ীর গা লাগানো মাদ্রাসা। মামা-খালাদের সাথে কবে যে খেজুর পাতার উপর বসে ছাত্রজীবন শুরু হয়ে গিয়েছিল মনেই নেই। মাদ্রাসা থেকে চার বছর পর পালিয়ে গেলাম প্রাইমারী স্কুলে। উদ্দেশ্য প্রাইমারী স্কুলের ফার্স্ট বয়কে টপকানো। সহপাঠিদের টিটকারী ‘মাদ্রাসায় ফার্স্ট হওয়া খুবই সহজ, প্রাইমারীতে গেলে পারবা না’! সেই যে শুরু হয়ে গেল আর থামেনি পথ চলা। ব্যাক-প্যাক, বাথরুম ট্রেইনিং, লাঞ্চ-ব্যাগ, হাইজেনিং ট্রেইনিং সেগুলো স্বপ্নেও ছিলনা।

স্কুল অফিসিয়ালি শুরুর আগে কর্তৃপক্ষ ছাত্র/ছাত্রী সবাইদের একদিন ডেমো দেন।আমরা প্যারেন্টরা ক্লাস রুমে বসে দেখলাম ক্লাস টিচার কিভাবে পড়াচ্ছেন। কাঁচি দিয়ে পেপার কাটা, ক্রেইয়ন দিয়ে ছবি আঁকা, গ্লু দিয়ে কাগজ লাগানো, টবে সানফ্লাওয়ারের বীজ রোপন ইত্যাদি। কার্টুন ও গানের তালে তালে বর্ণমালার পরিচয় দিতে গিয়ে দেখলাম ভীষন মনোযোগী তরুনী টিচার যেন স্টুডেন্টদের চেয়েই বেশী নাচছেন।

আরেকদিন ছিল ‘প্যারেন্ট-টিচার-স্টুডেন্ট’ সিটিং। এটা ঠিক ক্লাস শুরুর এক সপ্তাহ আগে। মেয়েকে নিয়ে আমাদের উদ্বিগ্ন ও পরামর্শগুলোই মূলতঃ টিচারের সাথে শেয়ার করা।তিনি আমাদেরকে অভয় দিয়ে বললেন, ‘সিনিয়র স্টুডেন্টরা ভেরী কো-অপারেটিভ। তারা ওদের খুব হেল্প করবে। এক একজনকে বাস থেকে সোজা নিয়ে আসবে ক্লাস রুমে। এভাবেই তাদের কাজ ভাগ করে দেয়া হয়েছে। চিন্তা করোনা’। সামারাহ্‌র ক্লাস টিচার মিস পিকুলা লাঞ্চ ব্যাগ, ব্যাক-প্যাক, এক্সট্রা প্যান্ট-শার্ট, জুতা (দূর্ঘটনা সামাল দেয়ার জন্য স্কুল থেকে পরামর্শ দেয়া হয় কাছে রাখতে) ইত্যাদি রাখার জন্য প্রত্যেক ছাত্রদের জন্য বরাদ্ধকৃত ক্যাবি আমাদের দেখালেন । তিনি একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে লিখতে বললেন মেয়ের যেসব দিকটা আমাদের ভাল লাগে সেসব। কাগজটা হাতে নিয়ে একটু ভাবি। এমন লোককেও জানি প্রথমদিনেই হেড টিচারের কঞ্চির কষাঘাত আমাদের গ্রামের অনেককে আর স্কুলমূখী করতে পারেনি। সকাল ৯ টা থেকে একটানা সাড়ে তিনটা পর্যন্ত ভিন্ন দেশের সম্পূর্ণ অপরিচিত পরিবেশে সামারাহ্‌র প্রথম জীবনে ছন্দময়তা আসবে তো? অস্থির হয়ে যাই।

কানাডার স্কুলিং সিস্টেম বিভিন্ন ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। প্রত্যেক বোর্ড যে একই নিয়ম মেনে চলবে তা কিন্তু নয়। অনেক জায়গায় জে.কে হাফ-ডে’র মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে। কিন্তু আমাদের অঞ্চলে ফুল-ডে। পার্থক্য হল প্রত্যেক দিনের বদলে ফুল ডে ওয়ালাদের ক্লাস হয় সপ্তাহে মাত্র দুইদিন প্লাস দুই সপ্তাহে এক শুক্রবার।

আজ ৯ই সেপ্টেম্বর, ২০০৮। সামারাহ্‌র স্কুলের যাওয়ার চুড়ান্ত দিন। আগের রাতেই ওর মা যত্নসহকারে মোটামুটি প্রস্তুতিপর্ব সেরে রেখেছে। এখন শুধু স্যান্ডউইচ বানানো বাকি। খুব ভোরে ঘুম থেকে ডেকে উঠালাম। মনে হয় রেডী হয়েই ছিল। ধরমর করে উঠে বলে ‘আজ আমার স্কুল?’ বলি, ‘হ্যাঁ, আজ তোমার স্কুল’। ‘আমি বাসে করে যাব না?’ আমি বলি, ‘হ্যাঁ। তুমি বাসেই যাবা, মা।‘

আজ সামারাহ্‌ স্কুলে যাবে।
আজ মনে পড়ছে ২০০৪ সালের জানুয়ারির ৫ তারিখ। প্রচন্ড শীত, হিমাঙ্কের নীচে তাপমাত্রা। মিশিগানের আকাশ পরিস্কার। আগের রাতে মুষলধারায় বরফ পড়েছে। ফজরের নামাজ শেষে বাম দিকে সালাম ফেরাতেই ফোন রিং। এমন অসময়ে ফোন? ধরতেই ওপার থেকে হেনরীফোর্ড ক্লিনিকের মিডওয়াইফ রোস্কির কন্ঠ। ‘তোমার স্ত্রীকে এখনই নিয়ে আসো। আজকেই বেবি আউট করব আমরা।‘

ডিঊ ডেট পার হওয়ার তিনদিন পরও পেইন না উঠায় অনাগত বেবির কোন ক্ষতি যাতে না হয় সেজন্যই তাদের এই পরিকল্পনা।ওর মা তখনো নামাজ পড়েনি।ওজু করছে। ফোনের কথা কিছুই বলিনা। চুপচাপ বসে থাকি। মিডওয়াইফের পরামর্শ অনুযায়ী আগেই একটা ব্যাগ মোটামুটি গোছানো আছে। ওর নামাজ শেষে বললাম, ‘ব্যাগটা নাও, হাসপাতালে যেতে হবে’। চমকে উঠে ভয়ার্ত কন্ঠে ও বলে, ‘কেন?’

গাড়ীর ইমার্জেন্সী লাইট অন করে ফ্রি ওয়ের পাশ ঘেঁষে বিকল্প পথ ধরে ধীরে ধীরে ড্রাইভ করি। তুষারপাতের দরুন রাস্তাটি বেশ পিচ্ছিল। ছেলেপুলেরা থোকা থোকা সাদা বরফ দিয়ে রাস্তার দু’পাশে কৌতুক করে ‘পোলার বিয়ার’ বানিয়ে রেখেছে। সূর্যের নিস্তেজ ও মায়াবী রোদ বরফকণার উপর আছড়ে পড়ে সকালটাকে বেশ মনোরম সাজে সাজিয়েছে। আর আমি ড্রাইভ করছি নতুন জীবনের সন্ধানে। এক মায়ের পেটফুঁড়ে উৎসরিত হবে আরো একটি তাজা প্রাণ! কল্পনার সমুদ্রে সাঁতাড় কাটি আমি।

প্রায় পনের মিনিট পর ডেট্রোয়েট হেনরীফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি হলাম। বাচচা-কাচচা হওয়ার সময় বা পরবর্তী সবচেয়ে দূর্দান্ত নিদ্রাহীন দিন-রাতগুলোতে দেশে যেখানে পুরুষ মানুষদের খবরই থাকেনা, সেখানে পরবাসী মানুষগুলোর প্রতিটা মূহুর্তই যেন কাটে চরম ব্যস্ততা, শঙ্কা ও উদ্বিগ্নতায়।চাইল্ড বার্থ ক্লাসে তাই ইনস্ট্রাক্টররা বলেন, প্রেগন্যান্ট শুধু মাম্মি নন, ড্যাড্ডিও। ‘মায়ের পায়ের নীচে সন্তানের বেহেশত কথাটা’ কেন যে বলা হয়েছে তার প্রমাণও সহজেই মেলে। সন্তান প্রসববেদনার সাথে দুনিয়ার কোন কষ্টেরই বুঝি তুলনা নেই! আমাদের অনুরোধেই হাসপাতালের ডেলিভারী রুমে সাঁটানো ছিল ‘শুধুমাত্র মেয়েরাই ঢুকতে করতে পারবে’ এই ধরনের একটা সাইনবোর্ড। বয়স্ক এক অভিজ্ঞ সাদা মহিলা ছিলেন ধাত্রী। বললেন এ পর্যন্ত প্রায় তিনহাজার বাচচা তাঁর হাত দিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়েছে। সাথে ছিলেন এক নার্স। ভয়ংকর এই কষ্টের মুহুর্তে বললাম, ‘এই জন্যই মনে হয় আমাদের নবী বলেছেন, জননীর পায়ের তলায় সন্তানের বেহেশত’। কথাটা শুনে দুইজনই চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘Who is your Prophet?’ নাম বলতেই মিডওয়াইফ বললেন, ‘হি মাস্ট বি এ ওয়াইজ ম্যান’। বিরতিহীন টানা নয় ঘন্টা কষ্ট শেষে ৭ পাউন্ড ৭ আউন্স এবং একুশ ইঞ্চি উচ্চতার সামারাহ্‌কে পেলাম বুধবার ৬ই জানুয়ারীর বিকাল চারটা চৌদ্দ মিনিটে।

চোখের সামনে বড় হয়ে স্কুলে যাওয়ার বয়স ওর হয়ে গেল! আজকে অফিসে যাওয়া পিছিয়ে দেই। গতকাল অফিসের সবাই কংগ্রাচুলেশন দিয়েছে। ওর দিকে তাকিয়ে থাকি, মারাত্মক প্যাকড্‌ সে। পিঠে ‘ব্যাক-প্যাক’, এক হাতে ‘লাঞ্চ ব্যাগ’, অন্য হাতে ইমার্জেন্সী কাপড়চোপড় ও স্কেটস্‌সহ আরো একটি। সামারাহ্‌কে নিয়ে হলুদ রঙের স্কুলবাসের কাছে আসি। কানাডা আসা চার বছর হয়ে গেলেও কোন ধরনের বাস বা ট্রেনে উঠার অভিজ্ঞতা এখনো হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ও অভিজ্ঞের মত নিশ্চিন্তে অন্যান্য ছেলেমেয়েদের সাথে বাসের কোথায় গিয়ে যেন বসল! দেখতে পাচ্ছিলাম না। উলটো দিকে গিয়ে দেখি জানালার পাশে বসে হাসছে। আমি হাত উঁচু করে উড়ন্ত আদর জানিয়ে দিয়ে ‘আল্লাহ হাফেয’ বলি। আমাকে ‘বা....ই (b....y....e)’ বলে ফেরত দেয়, যার জন্যই মূলতঃ অপেক্ষা করেছিল প্রায় ছয়মাস! একসময় ২২১ নাম্বারের স্কুলবাসটি ছেড়ে দেয়।ওর অন্তবিহীন পথের এই মুহুর্তটা সূচনা ভেবে কিছু সময়ের জন্য কেন যেন আনমনা হয়ে যাই! দৃষ্টির সীমানার বাইরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমি কটকটে হলুদ রঙের চলন্ত বাসটির দিকে তাকিয়ে থাকি।

Thursday, October 2, 2008

A President's email and Our Negative Attitude

One of the most commonly used words in the West is “appreciate”. For any good job, this word is expressed in so many ways that it would have been hard for me to realize unless I had experienced it myself. If these Westerns don’t like something, they just remain silent, never would you hear them personally attack with words, as it is the case in our country. Even the policemen, while handing over tickets, would say nice words like “Have a wonderful day”, “take care”, etc. For today, let us keep aside all the negative sides we talk a lot about Western people and concentrate on this. The other day, at a baby center I came across 101 phrases to keep the young kids happy! “Wonderful”, “Angel”, “Cutey”, “You are so beautiful”, “You are really something”, “You really are outstanding in a bunch of kids, and I am not kidding at all” are just a few among others. I tried hard to match these with the way the teachers, religious leaders or the elder ones from our part of the world behave with kids. I tried hard, but in vain. While our teachers think they have “blessed” their students by marking a little higher than the lowest, the teachers from western hemisphere start marking with the assumption that their students have gained the fullest mark, and refrain from reducing marks unless they make any mistake. These people do make fun, but of weather or animals, while we spend hours making fun of other people. Politicians don’t mind joking around with their biggest opponent, causing no harm to their honor and dignity. Natural disasters like Tsunami can bring together two former US Presidents of two different poles, such as George Bush Sr. and Bill Clinton. Even the people from our closest neighbor, no matter how severe division they have among themselves, they never show it to others. Like us, they don’t make fun of the negative things of their own nation in front of non-Indians. The respected elders, knowledgeable ones can come to much use, as they serve as a huge tree giving us shelter and shade. At times, with wise words from their heart, they can create a wonderful feeling among the younger ones. Though their efficiency is limited, through their personality they can create a beautiful atmosphere. That is the reason we don’t even want our seriously ill, bed-ridden parents to leave this beautiful world. Even if they do leave us, we feel we are left outside in a stormy day with the umbrella taken off from top our heads. Not to mention, never did so many knowledgeable people ever rule our Bangladesh at any given time. We must say we are lucky from this perspective. Though we have seen many graduates, post-graduates or barristers at once, this is for the first time we are experiencing so many PhD’s among the rulers at a time. Presidential role is almost similar in the three neighboring countries of the Sub-continent. Though knowledgeable, their role was to remain silent, unvoiced and provide shelter as a big tree. Unless they blow up, it is never easy to realize how far-reaching the root is of these trees. Faruk Loghari blew up twice, once in 1996 and again in 1997 and dissolved two parliaments- “kicking out” two elected Prime Ministers, Nawaz Sharif and Benazir Bhutto. Even our polite and soft-spoken president Abdur Rahman Bishwash once showed off his power by firing an Army Chief just before the 1996 polls. These exclusive, serious men seated on that gorgeous throne, who are only seen of cutting ribbons, distributing certificates, performing prayers in opening ceremonies, visiting graveyards and placing flowers in their formal attire, sometimes also know how to exhibit their hidden power and create sense of responsibility among their people. While the Presidents and professors of America or other Western countries are busy jogging in a T-shirt or showing off their cowboy nature, the respectable people of the Subcontinent and Asia are busy competing how far more serious can they be, or, in other words, showing off how great personality they possess! If a student in Dhaka accidentally bumps into a teacher in a shopping mall and says out phrases like “Hey, my teacher is here” or “Are you crazy?!”, it is easy to guess what will be the fate of that student, the next day in class. As America awaits upcoming polls, interesting stories are already in the air, related to the front-runners, now Senators, Governors, Mayors, Congress Members, etc. It is heard that Mike Huckabee still refrains himself from touching a glass door while entering any store, as he didn’t forget his teen memory of earning pennies by wiping off finger-stains from glass doors. Mitt Romney used to work with wrench to stop the flow of sewage pipes. Hillary Clinton used to separate intestines from fish with a fork! Republican Fred Thomson used to work in a shoe factory. Democrat Barack Obama used to do the most odd job- collecting ice cream at Baskin’s Robbins, because he used to eat more than he collected! Republican Rudy Guiliani, before going to study Law, was a priest at a church and used to sell medicine. And if such stories of our great respectable people ever come out in the air, no wonder how ashamed they would be! Well, time has changed a lot these days. Anyway, we were talking about the most recent President of India- the nuclear scientist in sandals- Dr. A P J Abdul Kalam. Just a few days before he retired, he delivered a speech in Hyderabad and he himself distributed it among Indians worldwide through e-mail. Talking about e-mails, although the young generation school kids of our country have got themselves already used to e-mailing and chatting, it is heard that it is not very well practiced among our senior executives. Some bigmouth people have already spread a rumor related to this: One of our senior executives had once gone to Australia to attend a conference. During break time, delegates from other countries asked him his e-mail address. He replied, “I didn’t get it yet, I will give you after asking my secretary”. Well, this is also just another joke that has no last answer. So, we do not know what the delegates replied. Well, criticizers did their job; let’s not believe in it. We were talking about the speech by Dr. A P J Abdul Kalam. As the topic of his speech matches so much with the case of Bangladesh, it is sensible enough to talk about it. He asked his fellow Indians: “Why is the media here so negative? Why are we in India so embarrassed to recognize our own strengths, our achievements? We are such a great nation. We have so many amazing success stories but we refuse to acknowledge them. Why? We are the first in milk production. We are number one in Remote sensing satellites. We are the second largest producer of wheat. We are the second largest producer of rice. Look at Dr. Sudarshan, he has transferred the tribal village into a self-sustaining, self-driving unit. There are millions of such achievements but our media is only obsessed in the bad news and failures and disasters.” He says, “I was in Tel Aviv once and I was reading the Israeli newspaper. It was the day after a lot of attacks and bombardments and deaths had taken place. The Hamas had struck. But the front page of the newspaper had the picture of a Jewish gentleman who in five years had transformed his desert into an orchid and a granary.””It was this inspiring picture that everyone woke up to. The gory details of killings, bombardments, deaths, were inside in the newspaper, buried among other news. In India we only read about death, sickness, terrorism, crime. Why are we so NEGATIVE? Another question: Why are we, as a nation so obsessed with foreign things? We want foreign TVs, we want foreign shirts, we want foreign technology.”He asks the conscience of the people of his nation, “Do we not realize that self-respect comes with self-reliance? I was in Hyderabad giving this lecture, when a 14-year-old girl asked me for my autograph. I asked her what her goal in life is. She replied: I want to live in a developed India. For her, you and I will have to build this developed India.”He seeks 10 minutes from his nation saying, “You must proclaim. India is not an under-developed nation; it is a highly developed nation. Do you have 10 minutes? Allow me to come back with a vengeance. Got 10 minutes for your country? If yes, then read; otherwise, choice is yours”“YOU say that our government is inefficient.YOU say that our laws are too old. YOU say that the municipality does not pick up the garbage.YOU say that the phones don't work, the railways are a joke, The airline is the worst in the world, mails never reach their destination.YOU say that our country has been fed to the dogs and is the absolute pits.YOU say, say and say.” Now he asks the hard question, “What do YOU do about it?”Then he tells his nation, “Take a person on his way to Singapore. Give him a name - YOURS. Give him a face - YOURS. YOU walk out of the airport and you are at your International best. In Singapore you don't throw cigarette butts on the roads or eat in the stores. YOU are as proud of their Underground links as they are…. YOU would not dare to buy an employee of the telephone exchange in London at 10 pounds (Rs.650) a month to, 'see to it that my STD and ISD calls are billed to someone else. 'YOU would not dare to speed beyond 55 mph (88 km/h) in Washington and then tell the traffic cop, 'Jaanta hai main kaun hoon (Do you know who I am?). I am so and so's son.Take your two bucks and get lost.' YOU wouldn't chuck an empty coconut shell anywhere other than the garbage pail on the beaches in Australia and New Zealand. Why don't YOU spit Paan on the streets of Tokyo? Why don't YOU use examination jockeys or buy fake certificates in Boston??? We are still talking of the same YOU. YOU who can respect and conform to a foreign system in other countries but cannot in your own. You who will throw papers and cigarettes on the road the moment you touch Indian ground. If you can be an involved and appreciative citizen in an alien country, why cannot you be the same here in India?Once in an interview, the famous Ex-municipal commissioner of Bombay, Mr. Tinaikar , had a point to make. 'Rich people's dogs are walked on the streets to leave their affluent droppings all over the place,' he said. 'And then the same people turn around to criticize and blame the authorities for inefficiency and dirty pavements. What do they expect the officers to do? Go down with a broom every time their dog feels the pressure in his bowels?In America every dog owner has to clean up after his pet has done the job. Same in Japan. Will the Indian citizen do that here?' He's right. We go to the polls to choose a government and after that forfeit all responsibility. We sit back wanting to be pampered and expect the government to do everything for us whilst our contribution is totally negative. We expect the government to clean up but we are not going to stop chucking garbage all over the place nor are we going to stop to pick a up a stray piece of paper and throw it in the bin. We expect the railways to provide clean bathrooms but we are not going to learn the proper use of bathrooms. We want Indian Airlines and Air India to provide the best of food and toiletries but we are not going to stop pilfering at the least opportunity.This applies even to the staff who is known not to pass on the service to the public. When it comes to burning social issues like those related to women, dowry, girl child! and others, we make loud drawing room protestations and continue to do the reverse at home. Our excuse?'It's the whole system which has to change, how will it matter if I alone forego my sons' rights to a dowry.' So who's going to change the system?”In his one and a half page long speech, he gave many more thought provoking examples like this. “Like lazy cowards hounded by our fears we run to America to bask in their glory and praise their system”, he says. “When New York becomes insecure we run to England. When England experiences unemployment, we take the next flight out to the Gulf. When the Gulf is war struck, we demand to be rescued and brought home by the Indian government. Everybody is out to abuse and rape the country. Nobody thinks of feeding the system. Our conscience is mortgaged to money.”He finished his speech echoing J. F. Kennedy 's words to his fellow Americans to relate to Indians.....We can also end this discussion like him. But before that, let us pay a little attention to how we do ourselves is: Our newspapers make lead news of how three brilliant students from BUET dies in Buriganga, but we never hear of their golden success stories. In this 21st century we get to see how hundreds of hunger-stricken people compete for the food thrown from a helicopter in those rural areas where SIDR had taken away millions of lives, but we never get to see anything to make them overcome this trial and gather back their strength to live again. Where do we hear the story of how, with the same hands these energetic people gather the torn out body of their closed ones from trees and paddy fields, put it into grave and get back, with the same hands to earn a living. When the whole world appreciates us with a “Well done Bangladesh” for the way we fought back with one of the greatest disasters of the century, we are busy blaming each other instead of participating in the effort to bring them back to life. In the June 2007 O Level exams of University of Cambridge International Examinations (CIE), three Bangladeshi kids, Ibrahim Mohammad Junaidur Rahman, Nabil Tarik Hossain and Sajjad Khan Moushum scored the highest number in three subjects across the whole world! Where the Director of CIE does not hesitate to feel proud of them, none of our newspapers, except very few came forward to write an editorial on these golden kids, pride of our nation. Another Bangladeshi origin American Mohammad Rahman, is doing PhD in Bio-engineering in a combined project of American Texas University and Indian TATA Memorial Hospital. He discovered an unbelievable patent, researching on “Oral Cancer Screening Device”, he invented a machine named The Portable Screening System (PS2), which is cheap and can be run on battery. It can diagnose oral cancer by differentiating between normal and pre-cancer tissues. Even the M. D professors of University of Texas are proud of him. And in our country, days after days Yaba queen Nikita gains a big portion of the lead news, while our pride Mohammad Rahmans’ news is hardly in the lead. These few are not the only success stories we have. Many such examples are scattered around us. But we the unfortunate are only busy with the rotten dead bodies of the animals and ill-fated people, the diseases around us and the terrorism of our country. Now let’s consider the above e-mail and imagine three things: First, let’s imagine Dr. Iajuddin instead of Dr. Kalam; second, let’s imagine Bangladesh instead of India; and third, the way Dr. Kalam echoed how J F Kennedy addressed to fellow Americans, let’s imagine Dr. Iajuddin echoing the same to fellow Bangladeshis:“ASK WHAT WE CAN DO FOR BANGLADESH AND DO WHAT HAS TO BE DONE TO MAKE BANGLADESH WHAT AMERICA AND OTHER WESTERN COUNTRIES ARE TODAY"

Please click here to read in NFB

[The article was originally written in Bengali language, and published in a national bangla daily JaiJaidin on Decemeber20, 2007. Maimuna Musarrat who is serving as Administrative Coordinator in 'Asian University for Women' in Bangladesh translated it. Her email address: munamust@yahoo.com]