Friday, March 27, 2009

দূঃসময়ের সাক্ষী



‘ফরেন পলিসি’ নামে একটি আমেরিকান থিঙ্ক ট্যাঙ্ক কোনো দেশের বিদ্যমান রাজনীতি, মিলিটারি, অর্থনীতি ও সামাজিক উপাদানগুলোর প্রধানত ১২টি সূচক নিরীক্ষা করে ‘ব্যর্থ বা অকার্যকর রাষ্ট্র’-এর সার্টিফিকেট ইস্যু করে থাকে। এগুলোর মধ্যে সংবিধান অবজ্ঞা, নিরাপত্তাহীনতা, প্রতিরাহীনতা, বাজে অর্থনীতি এবং অসম উন্নয়নের পাশাপাশি পাবলিক সার্ভিস, মানবাধিকার, মানবপাচার, ভূরাজনৈতিক চাপ এবং বহির্দেশীয় হস্তক্ষেপ প্রভৃতি উলেখযোগ্য। প্রতিটি পয়েন্টে দেশের মধ্যে গড়ে সাড়ে ৯ এবং সর্বমোট ১১৪ দশমিক ২ পয়েন্ট পেয়ে শীর্ষস্থান অধিকার করায় ‘ব্যর্থ রাষ্ট্রে’র খেতাবটি সোমালিয়ার কপালে জুটেছে। সুদানের ঝুলিতে ১১৩, জিম্বাবুয়ের ১১২ দশমিক ৫, শাদের ১১০ দশমিক ৯ এবং ইরাকের ভাগে পড়েছে ১১০ দশমিক ৬ পয়েন্ট করে।

এ ব্যাপারে কোনোই সন্দেহ নেই যে, সোমালিয়া বর্তমানে এমনই এক দেশ যেখানে শান্তি নেই, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন তো দূরের কথা দুই দশক ধরে কার্যকর কোনো সরকারও নেই সেখানে। সব জাতীয় প্রতিষ্ঠান অকার্যকর থাকায় দেশটির নেগেটিভ ইমেজ বিশ্বে বহুল পরিচিত।

কী কারণে সোমালিয়া এ পর্যায়ে এসে পৌঁছল? কারাই বা এর জন্য দায়ী? এ থেকে বাংলাদেশের এ মুহূর্তে কি কিছু শেখার রয়েছে? সোমালিয়ানরাও তো আমাদের মতো হোমোজিনিয়াস বা সমসত্ত্ব জাতি! তারা সবাই দেখতে মোটামুটি একই রকম। একই ভাষা, বর্ণ এবং শতকরা ১০০ ভাগ অভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মধ্যে কোন বিরোধের ফলে বর্তমানে তাদের এই লজ্জাকর পরিণতি? আমাদের মতো সাহিত্য-সংস্কৃতিপ্রেমিক এবং বিজয়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্যসমৃদ্ধ এককালের গর্বিত দেশ সোমালিয়া কেনইবা গৃহযুদ্ধ, অরাজকতা ও লুটপাটের রাজত্বে পরিণত হয়ে গেল?

সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত সোনালি অধ্যায় ছিল সোমালিয়ার। তাদের নতুন নতুন অনেক শহর তৈরি আর অবিশ্বাস্য রকমের উন্নয়নের স্মৃতি পুরনো দিনের ঢাকার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। নবম শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত হয় ইউরোপের বড় বড় শহরের একই আদলে মোগাদিসু শহর। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা চলে পনেরো শতক পর্যন্ত। সুলতান আহমদ ইবনে ইব্রাহিম আল গাজীর নেতৃত্বে ১৫৪৩ সালে সোমালিয়ানরা ‘ওইনা দাগা’র যুদ্ধে ইথিওপিয়ান-পর্তুগিজ যৌথ বাহিনীকে পর্যদুস্ত করে ইথিওপিয়ার তিন-চতুর্থাংশ দখল করে নেয়। এরপর ফ্রেঞ্চ, ব্রিটিশ, ইতালী অনেকেই এলো। সোমালিয়ান বীর, প্রবাদপুরুষ মুহাম্মদ আবদুলাহ হাসান হজ্জ্ব থেকে ফিরে এসে দেখেন, তার দেশ ব্রিটিশ কলোনির অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। এমনকি, ব্রিটিশ সৈনিকরা আবদুলাহকে নিজ দেশে ঢুকতে পর্যন্ত বাধা দিয়ে বিনিময়ে অর্থ দাবি করেছিল। অগ্নিমূর্তি ধারণ করে হাজী আবদুলাহ হাসান চড় মেরে বসেন দখলকারী এক ব্রিটিশ সেনাকে। অল্প সময়ের মধ্যেই অজেয় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ব্রিটিশরা তাই তার নাম দেন ‘ম্যাড মোলা’। ১৯৩৬ সালের মোগাদিসু টাউনের ছবি দেখলে সহজেই লালবাগের কেলা বা সোনারগাঁওয়ের পুরান চেহারা যে কারো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করবে।

‘আফ্রিকার শিং’ বা ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ বলা হয় সোমালিয়াকে। আরব সাগর ও লোহিত সাগরের কোল ঘেঁষে ইরিত্রিয়া, জিবুতি, ইথিওপিয়া ও সোমালিয়া মিলে মানচিত্রে গণ্ডারের শিঙের আকৃতির মতো দেখায় বলেই জায়গাটির এ নামকরণ। লোহিত সাগরের মুখে অবস্থান বলে সোমালিয়া মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার সাথে ব্যবসায়-বাণিজ্যে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। ভারত সাগরও এখানে এসে মিলেছে। অন্যভাবে বলা যায়, গুরুত্বপূর্ণ এই ভৌগোলিক কৌশলগত অবস্থানই সোমালিয়ার ওপর সাম্রাজ্যবাদীদের লোলুপদৃষ্টির মূল কারণ। বর্তমানে ঠিক বঙ্গোপসাগর ও চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে এমন চক্রান্তই চলছে। প্রায় ৬ লাখ ৩৮ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের সোমালিয়ায় আনুমানিক ১৪ মিলিয়ন জনসংখ্যার বেশির ভাগ বাস করেন উর্বর ভূমি, বিশেষত জুবা ও শেবেল নদীর উপকূলবর্তী অঞ্চলে। মাত্র ১৫-২০ ভাগ মানুষের বাস শহরাঞ্চলে।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় (১৯৬০) সোমালিয়া আফ্রিকার গ্রামীণ গণতন্ত্রের মডেল বলে পাশ্চাত্যে খ্যাতি লাভ করেছিল। ১৯৬৯ সালে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্যে আর্মি কমান্ডার সাঈদ বারী (সোমালিয়ানরা তাকে সিয়াদ বারী বলে ডাকেন) ততকালীন প্রেসিডেন্ট আবদুর রশিদ আলী শেরমার্ককে হত্যা করে মতা দখল করেন। তিনি সোমালিয়ার ঐতিহ্যের সাথে সঙ্গতি রেখে গড়ে তোলেন চীনের আদলে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’। নিজেকে ঘোষণা করেন জ্যালে সাঈদ বা কমরেড সাঈদ হিসেবে। রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সোমালিয়ানদের জন্য অনেক ভালো কাজও তিনি করেছেন। নিচু থেকে উচ্চ সব পর্যায়ের শিক্ষাই সবার জন্য বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক করেছিলেন। শিক্ষালয়ে প্রত্যেকের জন্য কুরআন শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেছিলেন, যার কারণে এখনো সব সোমালিয়ানই সুন্দর করে কুরআন তিলাওয়াত করতে সম। সার্বজনীন রূপ দিতে সোমালিয়ান ভাষা রোমান হরফে লেখা চালুর ব্যবস্থা তিনিই করেছেন, যেমনটি মালয় ভাষার ক্ষেত্রে মাহাথির মোহাম্মদ করেছেন। একটানা ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থেকে ‘লাল ঘোড়া দাবড়িয়ে’ বেড়ান কমরেড সাঈদ বারী।

সোমালিয়াকে আয়ত্তে রাখা দুই পরাশক্তি আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এর মূল কারণ আমরা আগেই বলেছি। সাইদ বারীকে এক পর্যায়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ত্যাগ করলে ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি তাদের সাথে আগের সব মৈত্রী চুক্তি বাতিল করে দেন। বহিষ্কার করেন স্পর্শকাতর বিভাগগুলোতে কর্মরত ডজন ডজন রুশ উপদেষ্টা। আনুগত্যের মস্তক এবার ঝুঁকে পড়ে পাশ্চাত্যের দিকে। দেশটির পতন মূলত তখন থেকেই শুরু হয়। সোমালিয়ানরা বলে থাকেন, রাশিয়ার কথা মতো ১৯৭৭-৭৮ সালে ইথিওপিয়া আক্রমণই ছিল বারী প্রশাসনের সবচেয়ে বড় ভুল, ঠিক সাদ্দাম হোসেন যেমন আমেরিকার ভুয়া প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ইরাক ধ্বংসের বীজ বুনেছিলেন কুয়েত আক্রমণ করে। ইথিওপিয়ার দখলকৃত ঔপনিবেশিক আমলের সোমালিয়ার দ্বীপগুলো (যেগুলোতে এখনো সোমালিয়ানভাষীরা বাস করেন) কব্জা করার পর সোভিয়েত ইউনিয়ন সোমালিয়া থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। কিউবা ও সোভিয়েত মিলে সাঈদ বারীর অপ্রতিরোধ্য হস্ত সঙ্কুচিত করতে বাধ্য করে। এই অঞ্চলে নৌ-স্থাপনার মোক্ষম সুযোগ ভেবে সাঈদ বারীর ‘নতুন প্রেমিক’ বেশে আসে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ওদের আশীর্বাদ অব্যাহত থাকে। বিনিময়ে জোটে অর্থনীতি ও সামরিক খাতের নাম করে বছরপ্রতি ১০০ মিলিয়ন ডলারের ‘প্যাকেজ ডিল’, ঠিক যেমনটি জেনারেল পারভেজ মোশাররফ পেয়েছেন বুশের তথাকথিত ওয়ার অন টেররের প্রেমিক সেজে।

সোমালিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্র করতে একনায়ক সাইদ বারীকে আমেরিকা ও রাশিয়া ইচ্ছামতো ব্যবহার করেছে। আরেকটি সত্য কথা হলো, বাংলাদেশের মতো সোমালিয়ারও কপাল খারাপ। ভালো প্রতিবেশী নেই। পূর্ব থেকেই সোমালিয়াবিরোধী কর্মকাণ্ড ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন প্রতিবেশী দেশ ইথিওপিয়া থেকে উতসারিত হয়ে আসছে। ওদিকে ইথিওপিয়া হলো পরাশক্তির আজ্ঞাবহ। গোত্রীয় বা গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব সোমালিয়াতে আগে থেকেই ছিল। দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত স্বৈরাচারী বারী প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণহীনতার সুযোগে সেটিও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বিদ্রোহী ব্যবসায়ী নেতা আলী মাহদি এবং মিলিটারি কমান্ডার ফারাহ আইদিদ মোগদিসু আক্রমণ করে বসেন। ১৯৯১ সালের ২৬ জানুয়ারি বারী যুগের অবসান ঘটে। তারপর যা হওয়ার তাই-ই শুরু হয়ে গেল। রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনী বলে কিছু রইল না। কমান্ড, শৃড়খলা একে একে খসে পড়ে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ল সোমালিয়া। অস্ত্র চলে গেল ট্রাইবাল লিডার, গডফাদার ও দস্যুদের (যারা সমুদ্রের জাহাজ পর্যন্ত ছিনতাই বা জিম্মি করে অর্থ দাবি করে) হাতে। শুরু হলো অরাজকতা, ডাকাতি ও লুটপাটের রাজত্ব। দুঃসময়ের সাক্ষী সোমালিয়ানরা স্ববদেশভূমি ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন পৃথিবীতে। ১০০ শতাংশ শিতি এবং অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ সোমালিয়ান জাতি এবং এক সময়কার ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড’দের নতুন পরিচয় হলো ‘যাযাবর’। অকার্যকর তত্ত্বের এ যেন সফল কার্যকরণ!

১৯৭৫ সালের আরেক ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ সিকিমের কাহিনীও মোটামুটি একই রকম। দুঃসময়ের এ যেন আরেক সাক্ষী। মাত্র ৭ হাজারের একটু বেশি বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ক্ষুদ্র রাষ্ট্র সিকিমকে ভারত ২২তম প্রদেশ বানিয়ে অন্তর্ভুক্ত করার আগ পর্যন্ত ৩০০ বছর ধরে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী চোগিয়াল রাজারা শাসন করতেন। মানুষগুলো সবাই দেখতে একই রকম। বেশির ভাগই নেপালি বংশোদ্‌ভূত এবং হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। হিমালয়ের পাদদেশে ছবির মতো সাজানো একটি দেশ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ও প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন, সিকিমের পুরনো নাম হিন্দু ধর্মের দেবতার নামানুসারে ছিল ‘ইন্দ্রকিল’ অর্থাত ইন্দ্র দেবের বাগান। মানচিত্রে বুড়ো আঙুলের মতো দেখতে। সিকিমের চার পাশে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ, ভুটান, চীনের তিব্বত ও নেপাল। বিশ্বের পর্যটকদের কাছে ‘হট স্পট’ বলে পরিচিত ছিল সিকিম। কিন্তু ষড়যন্ত্র তাদেরকেও ছাড়েনি।

সিকিমের সর্বশেষ যুবরাজ পলডেন নমগিয়াল মতা গ্রহণের আগে ১৯৬০ সালে নিউইয়র্ক পরিভ্রমণ করেন। তখন সাক্ষাত মেলে আমেরিকান ধনাঢ্য মেয়ে হোপ কুকের। বৌদ্ধ রীতি অনুযায়ী বিয়েও করেন তাকে। বৃদ্ধ রাজা তাশি নমগিয়াল মারা যান ১৯৬৩ সালে। এবার নতুন ও সর্বশেষ চোগিয়াল রাজা হলেন আমেরিকান মেয়ের বর পলডেন। ভারতের আশীর্বাদ নিয়ে গঠন করেন মন্ত্রিসভা। এই অসময়ে প্রতিবেশী অন্য দেশগুলোতেও রয়েছে ভারতের ‘পরীক্ষিত-বন্ধুরা’ ক্ষমতায়। রাজ্য হারানোর মর্মান্তিক গল্পের শেষ অধ্যায় হলো, ১৯৭৩ সালে হঠাত দেশব্যাপী শুরু হয়ে যায় চরম গোলযোগ ও অস্থিরতা। রাজা পলডেনের অমতা সম্পর্কে ভালো করেই জানা ছিল ভারতপন্থী সব বলয়ের। সিকিমের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা তো চুক্তি অনুসারে বরাবরই ভারতের হাতে। নেহেরু ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে এভাবেই শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেয়ার মতো সিকিমের কথিত স্পেশাল স্ট্যাটাসের ব্যবস্থা করে রেখে গিয়েছিলেন। ভারতীয় গণমাধ্যম ইতোমধ্যে সার্থকভাবে বিশ্বব্যাপী প্রচার করে সিকিমের বিরুদ্ধে ‘অকার্যকর রাষ্ট্রের তত্ত্ব’। এরই ধারাবাহিকতায় সুযোগ বুঝে ১৯৭৫ সালে দেশটিকে সম্পূর্ণভাবে গিলে ফেলে ভারত। সর্বশেষ রাজা পলডেন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান শ্বশুরবাড়ি নিউইয়র্কে ১৯৮০ সালে।

বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিত আমরা বলতে পারি, আমাদের প্রিয় দেশটি সোমালিয়া বা সিকিম হওয়ার পর্যায়ে আসেনি। আমাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আবারো ঘুরে দাঁড়াবে, ‘কমান্ড অব চেইন’ দ্রুত ফিরে আসবে, শোককে শক্তিতে পরিণত করে আবার সম্মুখপানে আমাদের সেনারা ধাবিত হবেন, অন্তত এ আশাটুকু করতে চাই। যত অপপ্রচারই চালানো হোক না কেন, কারো সাধ্য নেই এ দেশকে ‘অকার্যকর রাষ্ট্রে’ পরিণত করা। অনেক চেষ্টা করে ভুটানকেও পারেনি। ভুটান আজ নিজ্ব প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলছে। নেপালে অনেকবার ‘প্রো-ইন্ডিয়ানরা’ শাসন করেছেন, এমনকি ভারতীয় সেনাবাহিনী পর্যন্ত সেখানে দীর্ঘদিন মোতায়েন থেকেছে। কাজ হয়নি। বরঞ্চ ভারতবিরোধী শক্তিই দিন দিন বেড়েছে সেখানে। মাওবাদীরা আজ নেপাল শাসন করছেন। শ্রীলঙ্কার অবস্থাও অনুরূপ। কোনো প্রতিবেশীই ভারতের ‘অবিশ্বাসী প্রভুত্ব’ চায় না। বৃহত রাষ্ট্রের উসকানিমূলক প্রচারণা এবং তথাকথিত গবেষণা প্রতিবেদন বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রতিফলিত না হলে জাতি তার অস্তিত্ব সঙ্কটে কখনো পড়বে না।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, মোট চারটি উপাদান নিয়ে একটি কার্যকর রাষ্ট্রের সংজ্ঞা নিরূপিত হয়। জনগণ, সরকার, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড ও সার্বভৌমত্ব। শেষোক্ত দু’টি উপাদানের মূল নিয়ন্ত্রণকারীদের বাংলাদেশে আমরা নাম দিয়েছি বাংলাদেশ রাইফেলস ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। যদি রাষ্ট্রের উপরি উক্ত উপাদানগুলোর ভঙ্গুরতা সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া যায়; অর্থাত বিভাজিত জনগণ, একদেশদর্শী কিংবা বিদেশপ্রেমিক সরকার এবং সার্বভৌমত্ব ও ভূখণ্ডের নিরাপত্তাহীনতা, তখনি কথা এসে যায় অকার্যকর বা ব্যর্থ রাষ্ট্র হওয়ার। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর একটা সুশৃংখল বাহিনীকে শেষ করে ফেলার অপপ্রয়াসের মতো নির্মম ঘটনা এ দেশে ঘটেনি। এর চেয়েও নির্মম সত্য হলো, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর এমন গুরুতর হামলাও জাতিকে বিভাজনের হাত থেকে রক্ষা করতে পারল না। বরঞ্চ স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্ম ও বাংলাদেশের শত্রুরা এই সুযোগে ভালো করে আবারো বুঝে নিলো, বর্তমানের অপরিচ্ছন্ন ও নোংরা রাজনীতি কোনো কিছুতেই এই জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারবে না; এমনকি দেশের অস্তিত্বের ওপর চূড়ান্ত হামলা এলেও! অধিকন্তু দিনে দিনে আশঙ্কা বেড়েছে, উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত নব নব উদ্ভট এবং বিভক্তি উতপাদনের বিকৃত বীজ প্রজন্মের পর প্রজন্ম বহন করে চলতে পারে। এভাবে চলতে থাকলে আজ থেকে ২০ বছর পর ভবিষ্যত বাংলাদেশের চেহারা কেমন হবে? নাইন-ইলেভেন আমেরিকানদের অনেক কিছু শেখালেও ওয়ান-ইলেভেন মনে হয় আমাদের কিছুই শেখায়নি! স্কটিশ একটি প্রবাদবাক্য হলো, ‘জোর করে ঘোড়াকে পানির কাছে নেয়া যায়, কিন্তু তাকে পানি পান করানো যায় না।’ ঘুমের মানুষকে জাগানো যায়, কিন্তু যারা জেগে ঘুমায়, তাদের জাগাবে কে?