Sunday, June 21, 2009

মন্ত্রীদের সত্য কথা বলতেই হবে

মন্ত্রীর মূল ধাতু ‘মন্ত্র’ শব্দটি সংস্কৃত থেকে বাংলায় এসে ঢুকে পড়েছে। অর্থ হল বিচক্ষণ মানুষদের কথাবার্তা। পনেরোশ’ খৃষ্টপূর্বাব্দ বেদীয় যুগ থেকে এই শব্দটির চালু রয়েছে বলে বাংলাপিডিয়া লিখেছে। ভক্ত-অনুরক্তদের স্বর্গীয় ভাবাবেগে মত্ত করার জন্য তান্ত্রিক হিন্দু ও বৌদ্ধ উপাসনালয়ে নানা ধরনের ‘মন্ত্র’ উচচারিত হয়। ‘মন্ত্র’ দেয়ার শব্দসমূহ অতি পবিত্র বলে গণ্য, প্রাঞ্জল্য ভাষায় পংক্তিবদ্ধ এবং অতি পাওয়ারফুলও বটে। এতে মন প্রশান্তিতে ভরে যায়, কথার যাদু মালায় সর্বত্র‌ই যেন শান্তির ধারা পরিলক্ষিত হয়। তান্রিক ধর্ম মতে, ‘মন্ত্র’ দিতে গেলে অবশ্যই একজন গুরু লাগে, অর্থাৎ প্রধান মন্ত্রনাদানকারীকে ধরতে হয়। ধর্মাচারকে স্বতঃসিদ্ধ করতে একই মন্ত্রসমূহ সুন্দর, সাবলীল ভাষায় বারবার বলা চাই। যদিও চতুর্থ শতাব্দীর বেদিক পূরোহিত কাতসা এবং বৌদ্ধ দার্শনিকপান্ডব বাসুবন্ধু বলেছেন, ‘মন্ত্র ফন্ত্র হলো একদম বোগাস। ওসবে কোন কাজ হয়না।’
কাজ হোক বা না হোক ‘মন্ত্র’ শব্দের সাথে স্বর্গ ও আধ্যাত্মিকতার ভাব আছে বলে পশ্চিমেও পাদ্রীদেরকে ‘মিনিস্টার’ নামে ডাকা হয়। যেমন, অমুক হলেন ‘মিনিস্টার অব চার্চ হলিক্রস’ অর্থাৎ তিনি হলেন হলিক্রস চার্চের পাদ্রী ।

পানি-পড়া, মন্ত্র-পড়া, ওঝা বা গনকদের কাজ-কর্ম্মের প্রভাব খুব বেশী মানুষদের উপর পড়ে না। এক ব্যক্তি থেকে বড়জোর একটি পরিবার। কিন্তু দেশ চালানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ বা মন্ত্রী-মিনিস্টাররা বোগাস কথা বললে পুরো জাতি প্রভাবিত হয়, প্রতারিত হয়। এমনকি বিভ্রান্তিতে পতিত হওয়ার রেকর্ডও আছে। যেমন, বুশ তার দেশের গোয়েন্দা প্রধানের দেওয়া মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে ইরাক আক্রমণ করেছিলেন।
সারা দুনিয়ার শাসককূলই কম-বেশী এই মিথ্যা কথা বলার কাজটি সচেতনভাবেই করে থাকেন। অন্যভাবে বললে তারা ‘অধিক মিথ্যা’ কিংবা ‘কম সত্য’ কথা বলেন। ডঃ আসকার ইবন শাইখ ১৯ মে মৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগে এনটিভি’র একটি টকশো’ তে উপস্থিত হয়েছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল বর্তমানে কোন্‌ জিনিস তাঁকে সবচেয়ে ব্যথিত করে। তিনি এক বিন্দু চিন্তা না করে বলেছিলেন, ‘মিথ্যা ভাষণ। সর্বত্রই এখন মিথ্যা। উপর থেকে নীচ পর্যন্ত সবাই মিথ্যা কথা অবলীলায় বলে যায়’।
বাংলাদেশে এর চর্চা উপরদিক থেকে ইদানিং মারাত্মক আকারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ডিজিটাল জেনারেশন ধরে নিয়েছিল জড়াগ্রস্থ পুরোনো ব্যর্থ দিনগুলোকে পায়ে মাড়িয়ে নতুনরা দেশের দিনসব একদম বদল করেই ছাড়বে। কিন্তু বিধি বাম! লংকায় গেলে নাকি সবাই রাবণ হয়! আমাদের রাবনেরা এমন ভাবে মাথা ঝাকিয়ে, গা দুলিয়ে মিথ্যা কথা বলেন, ভাবেন হনুমানেরা বুঝি কিচ্ছু বোঝেনা! কত রাবনের প্রস্থান যে হনুমানদের ইতিহাসে ভরা সেসব নতুন করে বর্তমান রাবনদের বোঝাবে কে?
ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’ বাংলাদেশের সাথে অনেক দেশকেই কিছুটা হলেও ‘আউলা’ করে দিয়ে গেছে। স্বাধীনতার অন্যতম এক মহানায়কের গর্বিত সন্তান ও চৌকষ একজন মন্ত্রী যখন চারদিন ‘সর্দি’ বা ‘হাইবারনেশন’ শেষ করে স্বপ্রণোদিত হয়ে মিডিয়াতে বললেন, ‘কিসের পদত্যাগ? আমরা দিন বদলের জন্য কাজ করছি। পরিবর্তন আনতে চাইলে নিজেদের পরিবর্তিত করতে হবে। ত্যাগের মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে। কাজ করতে গেলে বাধা তো আসবেই সেগুলো ভেঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে (আমারদেশ, জুন৪, ২০০৯),’; ঠিক তখনি কানাডার পার্লামেন্টে তুমুল হট্টগোল বেধে গেল। হাউজ অব কমন্সে কানাডার ন্যাচারাল রিসোর্স মিনিস্টার লিসা রেইটের পদত্যাগের দাবী করল সবগুলো বিরোধী দল মিলে। লিসার স্বহস্তে লেখা ‘সিক্রেট’ সরকারী ডকুমেন্ট সিটিভি’র অটোয়া নিউজরুমে পড়েছিল। ৩ জুন লিসা হাউসে বিরোধী পার্লামেন্টেরিয়ানদের দাবীর মুখে বললেন, ‘অবশ্যই সঠিক পদ্ধতি না মানায় এই কান্ডটি ঘটেছে। পদত্যাগপত্র আমি আগেই জমা দিয়েছিলাম, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তা গ্রহন করেননি।’ প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার বিরোধী দলের তুমুল ‘হো’,‘হো’ ধবনির মধ্যে বললেন, ‘এটা লিসার ভুল নয়। তিনি ওই সময় সরকারী কাজেই অন্যত্র ছিলেন। তাঁর একজন স্টাফের অসতর্কতায় এমনটি হয়েছে। এর জন্য লিসাকে দায়ী করা সমীচিন নয়।’ এরপর আবারো মেডিক্যাল আইসোটোপ নিয়ে সহকারীর সাথে লিসার অসংলগ্ন কথাবার্তার টেপ জনসম্মুখে প্রকাশ হয়ে পড়ায় হারপার প্রশাসনও লজ্জা পেয়েছেন। লিসা সজল নয়নে দুঃখ প্রকাশ করেছেন পার্লামেন্টে সবার সামনে। ইতোমধ্যে রিসোর্স মিনিস্টার অফিসের কমিউনিকেশন বিভাগের ডিরেক্টর জ্যাসমীন ম্যাকডোনেল সব দায়-দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করে পদত্যাগের ঘোষনা দিয়ে ইস্যুটি থেকে নিজেকে সযত্নে প্রত্যাহার করে নিলেন।
আর ওদিকে ব্রিটেনের ইতিহাসে প্রথমবারের মত স্পীকারের পদত্যাগের পর সরকারে যেন শনির দশা লেগেই আছে। এক সপ্তাহের মধ্যেই চারজন ফুল মন্ত্রী এবং দু’জন জুনিয়র মন্ত্রী ‘ব্যক্তিগত’ কারন দেখিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। ওয়ার্ক এন্ড পেনশন বিষয়ক মন্ত্রী জেমস পার্নেল পদত্যাগপত্রটি পাঠানোর সময় সাহস করে প্রধানমন্ত্রী ব্রাউনকেও পদত্যাগের আহ্বান জানিয়ে সাথে একটি চিঠি জুড়ে দিয়েছেন। ব্রাউনের ‘শ্যাম না কূল রাখি’ অবস্থা! চিঠিতে পার্নেল লেখেন, ‘আমি মনে করি আপনার প্রধানমন্ত্রীর চেয়ার ধরে রাখা মানেই বিরোধী দলকে আগামী নির্বাচনে জয়লাভের সুযোগ করে দেয়া। ........ আমি আপনাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি, আপনি প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করুন এই যেমন আমি সরকার থেকে পদত্যাগ করছি।’ প্রধানমন্ত্রী এসব কথাকে উড়িয়ে দিয়েছেন। তাইতো দিবেন, শাসনে থাকলে সবাই এমন পরিচিত প্রতিক্রিয়াই প্রথমে দেখান।
যাহোক, সাধারন মানুষদের মত মন্ত্রীরাও বিপদে পড়ে গেলে মিথ্যা কথা বলেন। শুধু তাই নয়, পদ থেকে ইস্তফা দেয়ার সময়ও শেষবারের মত ‘ব্যক্তিগত’, ‘পারিবারিক’, ‘স্ত্রী-সন্তানকে সময়দান’, ‘সর্দিজ্বর’ ইত্যাদি জাতীয় কথাবার্তা বলে নিশ্চিত প্রস্থান চান। কৌশলজনক কথা বলে এড়িয়ে যাওয়া আর ডাহা বোকা মার্কা মিথ্যা কথা বলা এক নয়। ‘রাষ্ট্রের প্রয়োজনে’ এসব মিথ্যা ও বাড়তি কথা বলার পরিণতি অনেক সময়ই যে মারাত্মক তা এক-এগারো বাংলাদেশে খানিকটা হলেও বুঝিয়ে দিয়েছে। ভেবেছিলাম, ‘লুকিং ফর শত্রুজ’ মার্কা মন্ত্রীদের কবল থেকে দিন বদলের মন্ত্রীসভা রক্ষা পাবে। কিন্তু এ দেখছি বাঘের আক্রমন থেকে বাঁচতে গিয়ে সিংহের থাবায় পড়ে জাতি এখন ‘শকিং ফর দিন বদলের মন্ত্রীজ’!
‘মন্ত্রী’ শব্দটির সাথে পূত-পবিত্রের অমীয় ধর্মীয় গন্ধযুক্ত থাকলেও এখন তাতে মারাত্মক পচন ধরেছে। মিডিয়াতে এমনভাবে ইনারা মিথ্যা কথা বলেন যেন জনগন কিচ্ছু বোঝেনা! কিন্তু জনগন যে শুধু বোঝেন তাই ই নয়, মন্ত্রীরা মগজে কি চিন্তা লালন করেন সেটিও যে বলে দিতে পারেন, তা উনারা ঠাহর করতে পারেন না। সকল সরকারের দুই একজন ছাড়া সব মন্ত্রীই উচ্চশিক্ষিত হন। বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা প্রাপ্ত হন, আবার লেখাপড়া শেষ করে বিদেশীনিকে নিয়ে ঘর করছেন এমনজনকেও ধরে এনে মন্ত্রী বানানোর রেকর্ড আছে। কিন্তু বাংলাদেশের ভাইরাস এতই শক্তিশালী, বাইরের কোন ভাল অভ্যাসই এখানে কাজ করেনা। জিয়াতে নামলেই পূর্বের বদ অভ্যাসসমূহ মূহুর্তেই শরীরে এসে ভর করে। শুরু হয়ে যায় ঠিক পূর্বের স্থানে রেখে যাওয়া নোংরা বক্ররেখা থেকেই নতুন যাত্রা!

পাঠক, এবার আসুন আমাদের ‘চমক মন্ত্রীসভার’ চমকানো কথাসমুদ্র থেকে প্রতিদিনকার খন্ডিত কিছু কথা তুলে আনি।
গুরু মন্ত্রী সংসদে বললেন, ‘আগের আমলে অত হাজার কোটি টাকা শুধু বিদ্যুতের খাম্বা বাবদই লাপাত্তা হয়ে গেছে।’ পূর্ব্বতন মন্ত্রী বলেন, ‘তত কোটি টাকা তো পুরো বিদ্যুত মন্ত্রণালয়ের বাজেটেই ছিল না।’ আরেকজন মন্ত্রী সবদিক থেকেই এগিয়ে আছেন। ব্যবসায়ীদের বার্ষিক মিটিং-এ গিয়ে দেশে ব্যবসা-বানিজ্য ও কর্মবৃদ্ধির কথা বললেই ভাল শোনায়। তা না বলে বলেন, ‘জঙ্গি ও স্বাধীনতাবিরোধীরাই সেনা অফিসারদের মেরেছে (ইত্তেফাক, মার্চ ৭)। তাদের ইন্টারন্যাশনাল কানেকশন খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’ সরকারী তদন্ত কমিটি বল্ল, ‘না ওরা তো মারেনি (মার্চ২১, আমাদের সময়)।’ সাংবাদিকরা মন্ত্রীকে ধরে জিজ্ঞেস করল, দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হয়ে আপনি এ কথা বললেন কেন? মন্ত্রী বললেন, ‘আমার মনে হয়েছে তাই বলেছি (প্রথম আলো, আমারদেশ ২৪ মার্চ)।’তদন্ত কমিটির পুরো প্রতিবেদনটি জনসমক্ষে প্রকাশ না করার কারণ ব্যাখ্যা করে মন্ত্রী বললেন, ‘প্রতিটি দেশেই তদন্ত প্রতিবেদনে তিনটি বিষয় থাকে। এগুলো হচ্ছে ‘সিক্রেট (গোপনীয়), টপ সিক্রেট (অতি গোপনীয়) এবং ওপেন (প্রকাশযোগ্য)। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই গোপন জিনিস প্রকাশ করা হয় না। এ ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে। আগামীতে পুরো তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করার সম্ভাবনা নেই (নয়াদিগন্ত, মে২৯)।’ আরেক বড় মন্ত্রী মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের একই বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে বললেন, ‘যা প্রকাশ হয়েছে তাই ই পূর্নাঙ্গ। পূর্নাংগ প্রতিবেদনই জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়েছে (নয়াদিগন্ত, মে ২৯)।’
কুয়ালামপুর ৫৫ হাজার বাংলাদেশী ভিসা বাতিলের ঘটনায় মন্ত্রী বললেন, ‘এতে বংগবন্ধুর খুনী ও যুদ্ধাপরাধীদের হাত থাকতে পারে (আমারদেশ, মার্চ১৮)।’ ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র মহসিন শেখ ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাকে ক্রসফায়ারে হত্যা করার খবর সব পত্রিকা প্রকাশ করে স্বজনদের বরাত দিয়ে লিখল, ‘তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কোনো অভিযোগ নেই। কোনো থানায় একটি মামলা বা ডিও নেই। কেউ কখনো তাদের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের কাছেও অভিযোগ করেননি।সহপাঠী ও বন্ধুবান্ধবদের কাছেও তারা ছিল খুবই প্রিয়। (আমারদেশ, মে৩০)।’ দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী বললেন, ‘আমরা জনগণের সরকার। জনগণের সেবা করার জন্য ক্ষমতা নিয়েছি। প্রতিটি বিষয়ে আমরা সজাগ রয়েছি। আমরা সব সময় বিচারবহির্ভুত হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে। এ সরকারের আমলে বিচারবহির্ভুত হত্যার কোন ঘটনা ঘটেনি (যুগান্তর, আমারদেশ, মে৩১)।’ ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল ও কৃমিনাশক ট্যাবলেট খেয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে দেড় হাজারের বেশি শিশু অসুস্থ হয়ে পড়ার খবর প্রতিটি পেপার ও চ্যানেলের মাধ্যমে সারা দেশে খবর ছড়িয়ে গেল (যুগান্তর, জুন ৮; মানবজমিন, জুন ৯)। মন্ত্রী মহোদয় বিশ্বস্বাস্থ্যের দেয়া ঔষধগুলো রি-চেক, সঠিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয়েছে কিনা জানার প্রয়োজন বোধ না করে বললেন, ‘এসবই অপপ্রচার, যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, যারা শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে ২১ আগস্ট বোমা হামলা চালিয়েছে, যারা দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়, তারাই এ কাজ করছে (আমারদেশ, নয়াদিগন্ত, জুন৯)।’ সৌদী সফর থেকে ফিরে এসে আগের রেকর্ড না চেক করেই মন্ত্রী উক্তি, ‘বিগত সাত বছরে সৌদির বাদশাহ্‌র সাথে বাংলাদেশের কোনো প্রধানমন্ত্রীর এটাই প্রথম বৈঠক (জুন ৮, নয়াদিগন্ত)।’ মন্ত্রী বাংলাদেশ ও ভারতের মণিপুরের পানি বিশেজ্ঞদের অবাক করে দিয়ে পিনাকীয় সুরে বললেন, ‘টিপাইমুখে বাধ দিয়ে ভারত পানি বিদ্যুত তৈরী করলে বাংলাদেশের কোন ক্ষতি হবে না (আমাদের সময়, ২০ মে),’ এবং ‘খুশী হয়ে ভারত যতটুকু পানি তাই ই আমাদের লাভ (নয়াদিগন্ত ৮ জুন)।’
এসব আমাদের মন্ত্রীদের কথা, এরকম হাজারো উদ্ধৃতি দেয়া যায়। পাঠকদের ধৈর্য্যচুতি ঘটবে। আর হ্যাঁ, এসব উক্তির জন্য তো বিরোধীদলকেও দায়ী করা যাবেনা।
এমন মন্ত্রীদের দিয়েই আমরা ডিজিটাল বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখব, ভিশন ২০২১ বাস্তবায়নে এগিয়ে যাব, মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে শিখব। আশা করতে পারিনা?
সুন্দর করে কথা বলা একটা আর্ট। ‘সত্য কথা বলা’ কিংবা ‘কথা-বার্তার চেয়ে কাজ বেশী করা’ মন্ত্রীদের শিখতে হবে। সাংবাদিকদের মাইক দেখলেই দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হওয়া যাবে না। উন্নতদেশে মন্ত্রীরা মিডিয়া থেকে পালিয়ে বেড়ান, আর আমাদের দেশে মন্ত্রীরা অফিস থেকে বেড়িয়েই আট-দশটি মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে যান।
পাচঁ মাস খুব বেশীদিন নয়, এতে দিন বদল হয় না। তাই বলছিলাম, বাকী সাড়ে চার বছরে আমাদের মন্ত্রী-মহোদয়বর্গ ‘সত্য ও কঠিন কথা’ সোজা করে বলা শিখে যাবেন। আগের মন্ত্রীরা দেশটাকে বাজে অবস্থায় নিয়ে গেলেও আশা করবো দিন বদলের ‘ফ্রেশ’ মন্ত্রীরা এবার তা আর করবেন না। আরেকটা কথা না বললেই নয়, ইন্দিরা গান্ধীকে ভারতীয় সৈন্য ফেরত নেবার ‘কঠিন সত্য কথাটি’ কিন্তু সহজভাবে বলার রেকর্ড বাংলাদেশের রয়েছে। বাংলাদেশ কোন হেলাফেলাদের দেশ নয়। গর্ব করার মত অনেক কিছুই আমাদের রয়েছে। নোংরা ও অদূরদর্শী রাজনীতিবিদরা দেশটাকে এগিয়ে নিতে বাধা সৃষ্টি করলেও এদেশের মেধাবীরা বিশ্বে সৃজনশীল ইতিহাস সৃষ্টি করতে সাহায্য করছে। গ্লোবাল ভিলেজের যুগে মহারথীদের ভয়ে ভীত হবার কিছু নেই, মানে ইন্ডিয়ার নামটা আসলেই জিহবাটা যেন আড়ষ্ট না হয়ে যায়। জর্জিয়াতে রাশিয়া পারেনি, একক পরাশক্তি আমেরিকার প্রতিবেশী হয়ে ছোট্ট রাষ্ট্র কিউবা বুক ফুলিয়ে টিকে আছে, মহাশক্তিধর বুশ হা হয়ে ছিলেন যখন ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট মুখের উপর তাকে ‘শয়তান’ বলছিলেন। এসবের জন্য ছোট রাষ্ট্রদের যুদ্ধে যেতে হয়নি। আমরা অতি বিপ্লবী হতে চাইনা, দরকারও নেই। শুধু চাই আমাদের সোজা-সাপটা সত্য কথাটা মন্ত্রীরা জোরের সাথে বলুক, বিশ্ববাসী জানুক। মনে রাখতে হবে, ‘শয়তান’ যত বড় শক্তিশালীই হোক না কেন তার ষড়যন্ত্র বড়ই দূর্বল (আল-কোরআনঃ ৪:৭৬)। বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীও কিন্তু বারে বারে এর প্রমাণ দেখিয়েছে।
অস্টম শতাব্দীর জার্মান দার্শনিক কান্ট বলেছিলেন, ‘ফিয়াত জাস্টিফিয়া, পেরিট মুন্ডুস (ইনসাফ নিশ্চিত কর, যদিও পৃথিবী একদিন ধবংস হয়ে যাবে)।’ কথাটাকে ঘুরিয়ে তিনি অন্যভাবে এরকমও বলেছেন, ‘ন্যায়-বিচারকে সমুন্নত রাখো এমনকি পৃথিবীর সব ‘বান্দর’দেরকে এর মাধ্যমে শাস্তি দিয়ে হলেও।’

Thursday, June 4, 2009

তামিল রাষ্ট্র গঠন স্বপ্নই থেকে গেল


প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাক্সে খুশীতে গোটা শ্রীলংকা একদিন বন্ধ ঘোষণা করে আতশবাজি ফুটিয়ে বিজয় দিবস পালন করলেন। তামিল বাদে সিংহলীসহ সব সম্প্রদায়ের মানুষজন রাস্তায় নেমে একাকার উৎসবে মেতে উঠেছে। কি রাষ্ট্রপ্রধান, সেনাপ্রধান সবাই জনতার সাথে মিশে ডেকচি ভর্তি খাবার থেকে একে অপরের গালে তুলে দিয়ে জয় প্রকাশ করে খাচ্ছে। মাত্র দু’মাস আগেও এরকম দৃশ্য ছিল অকল্পনীয়। আর অন্যদিকে সারা বিশ্বের তামিলরা কাঁদছে। আইরিশরা এমনটি কেঁদেছিল আইরিশ গেরিলাদের পরাজয়ের পর। ১৭ মে ২০০৯ তারিখে স্বাধীন ভূমি প্রতিষ্ঠার আরো একটি স্বপ্নের করুণ মৃত্যু হয়ে গেল। সাথে থেকে গেল লক্ষ লক্ষ স্বজন হারানোর কত দূঃসহ স্মৃতি! রয়ে গেল বাস্তচ্যুত প্রায় তিন লাখ মানুষের পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম সবচেয়ে বড় উদ্বাস্তু শিবির। টাইগারদের বিদেশ শাখা প্রধান সেলভরসা পরাজয় মেনে নিয়ে বিবৃতি দিলেন, ‘আমরা গোলাগুলি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের কেবল দূঃখ যে, এতগুলো মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, যা আর বইতে পারছিনা!‘

চুড়ান্ত সেনা অভিযানের বেশ আগেই এলটিটিইরা ধরে নিয়েছিল এ যাত্রায় তারা আর বাঁচবেনা। সারা বিশ্বের লাখ লাখ তামিল ডায়াসপোড়াদের মধ্যে মূহুর্তেই এর পূর্বাভাস ছড়িয়ে পড়ে। উত্তেজনায় ফেটে পড়েন তারা। সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ বোধ করি হয় কানাডার টরোন্টো ও অটোয়ায়। ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে তামিল ছাত্ররা তাদের মানবাধিকার লংঘনের আবেদনে সাধারণ ছাত্রদের সম্পৃক্ত করতে সক্ষম হয়। ‘নো মোর জেনোসাইড ইন দ্যা শ্রীলংকা’, ‘স্টপ দ্যা ওয়্যার ইন শ্রীলংকা’, ‘উই ওয়ান্ট সিজফায়্যার’, ইত্যাদি ব্যানারে হাজার হাজার তামিলদের আন্দোলন কানাডা মিডিয়াতে বেশ কভারেজ পায়। একটানা সপ্তাহব্যাপী রাস্তা অবরোধ করে তারা টরন্টো শহরতলী অচল করে দেয়। এতেও এলটিটিইকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণাকারী কানাডিয়ান রক্ষণশীল সরকারের সহানুভূতি লাভে ব্যর্থ হয়ে গভীর রাতে তামিলরা নেমে আসে অন্টারিও’র সবচেয়ে ব্যস্ততম রাস্তা গার্ডিনার এক্সপ্রেসওয়ের টরোন্টো উপকন্ঠে। দূর্ধর্ষভাবে রাস্তা ব্লক করে, শিশু-কিশোর-যুবকদেরকে রাস্তার সামনে বসিয়ে হারিকেন, মোমবাতি জ্বেলে তারা অভূতপূর্বভাবে বিক্ষোভ করে। রয়্যাল কানাডিয়ান মেট্রো পুলিশ এধরণের ‘অনিরাপদ, ঝুঁকিপূর্ণ’ ও আইন অমান্য’ কর্মসূচী প্রত্যাহার করতে ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালায়। শেষমেষ বিরোধী দলীয় নেতা মাইকেল ইগনাটিফ ও জ্যাক লেইটন শ্রীলংকার মানবাধিকার লংঘণের বিষয়টি পার্লামেন্টে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আন্দোলনকে কোনমতে প্রশমিত করতে সফল হন। টরোন্টোতে আনুমানিক চল্লিশ হাজার, অটোয়াতে ষাট হাজার মানুষ নিয়ে তারা বিক্ষোভ করে যার সাথে শুধুমাত্র সাম্প্রতিককালে বুশবিরোধী আন্দোলনেরই তুলনা করা যায়। লন্ডনসহ বিশ্বের অনেক বড় বড় সিটিতেই ভারতীয় ও শ্রীলংকান তামিলরা মিলে এরকম বিক্ষোভ করেছেন। উল্লেখ্য, তামিল বসবাসরত প্রত্যেক দেশেই গেরিলাদের প্রতি সহানুভূতিশীল তামিলভাষীদের বিভিন্ন নামে সংগঠন রয়েছে। তাদের উপার্জিত আয়ের একাংশ তারা স্বাধীন তামিল প্রতিষ্ঠার দাবীতে আন্দোলনরত প্রিয় যোদ্ধাদের তহবিলে জমা দিয়ে এতদিন একাত্মতা ঘোষণা করে আসছিল।

১৯৭৬ সালের ৫ মে ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণ তামিলদেরকে আজন্মশত্রু সিংহলীদের থেকে মুক্ত করতে টিএনটি (তামিল নিউ টাইগার) গোষ্ঠীকে দক্ষতার সাথে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এবং দূর্ধর্ষ কর্ম সম্পন্নকারী শক্তিশালী একটি এলিট ফোর্স গঠণ করেন। নতুন নামকরণ করেন ‘এলটিটিই (লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম)’। ২৩ জুলাই, ১৯৮৩ তারিখে উত্তর ও পূর্ব শ্রীলংকার তামিলাঞ্চল জাফনার বাইরে লংকান সেনাদের উপর প্রথম হামলা চালিয়ে ১৩ জন সেনা খতম করে এলটিটিই তাদের শক্তিমত্তা বহির্বেশ্বে প্রথমবারের মত জানান দিয়ে যায়। অন্যদিকে গোটা তামিল সম্প্রদায়ের ভেতর স্বাধীনতার স্বপ্ন নতুন করে বাসা বাঁধে। দলে দলে তরুনরা টাইগারদের সাথে যোগ দেয়। মুক্ত দেশ পাওয়ার নেশায় উন্মাদ হয়ে এক একজন ভয়ংকর ও দূর্ধর্ষ গেরিলা হয়ে উঠে। এমনকি জীবন বিনাশী ‘সায়ানাইড ক্যাপসুল’ সবসময় তাদের গলায় শোভা পেত। আক্রান্ত হলেই তারা বিষের এই ট্যাবলেট গিলে মুক্ত দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করত। যদিও নির্মম বাস্তবতা হল, এর প্রবক্তা প্রভাকরণ জীবনের কঠিন সায়াহ্নে ‘সিংহলী’ সেনাদের থেকে বিষ খাওয়ার সেই সময়টুকু পাননি। আরো একটি প্র্যাকটিস তাদের মধ্যে ছিলো তা হল ‘Oath of loyalty’; তামিলরাষ্ট্র গড়ার আনুগত্যের কঠিন শপথ।

প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ঘাঁটিসমূহে আত্মঘাতী আক্রমণ চালানোর ব্রত নিয়ে ১৯৮৭ সালে এলটিটিই সুইসাইড স্কোয়াড ‘ব্ল্যাক টাইগার’ গঠণ করে। এবছরই তারা একটি আর্মি ক্যাম্পে প্রথম হামলা চালিয়ে চল্লিশজন সেনা বধ করতে সক্ষম হয়। ব্ল্যাক টাইগারদের মনোবল বহুগুণে চাংগা হয়ে উঠে। ‘নিরাপদ-যোদ্ধা’ হিসেবে শত শত কিশোর ও মহিলাদেরকে তারা প্রশিক্ষিত করে বহু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহে ছেড়ে দিয়ে ‘সফল’ আক্রমণের পারদর্শীতা দেখাত।

এই যুদ্ধে ভারতও একসময় প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৮৭ সালে অগনতি হতাশ ও উদবাস্তু তামিলদের ভেতর আভ্যন্তরীন অসন্তোষ তীব্রভাবে দেখা দেয়। সুযোগটি ইন্ডিয়া ভালভাবে কাজে লাগায়। একসময় ইন্দো-শ্রীলংকা শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যদিও দ্বন্দ্বটি ছিল মূলতঃ সিংহলী ও তামিলদের মধ্যে। পঞ্চাশ হাজার ‘ইন্ডিয়ান পিস কিপিং ফোর্স (আইপিকেএফ)’ শ্রীলংকায় চলে আসে। তামিলদের ক্ষুদ্র কয়েকটি গ্রুপ এ চুক্তি মেনে নিলেও টাইগাররা মানতে পারেনি। তাদের পছন্দের প্রতিনিধিকেও অন্তর্ভূক্ত করতে রাজী হয়নি ভারত। এলটিটিই’র অস্ত্র এবার ঘুরে যায় ইন্ডিয়ান আর্মির দিকে। এবছরই ৮ অক্টোবর রেশন ট্রাকের উপর হামলা চালিয়ে পাঁচজন ভারতীয় প্যারা-কমান্ডোকে মেরে গলায় জ্বলন্ত টায়ার পেঁচিয়ে রাখে যোদ্ধারা। আত্মসম্মান বাঁচাতে বেপরোয়া হয়ে উঠে অজনোপ্রিয় আইপিকেএফ। ‘অপারেশন পবন’ নামে তামিল নিধনে নির্মম অভিযান শুরু করে। টাইগাররাও হিংস্র ও প্রতিশোধপরায়ন হয়ে ওঠে। আগে থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলীরা ভারতীয়দের হস্তক্ষেপ কোনমতেই মেনে নিতে পারেনি। ফলতঃ দুই বছরের বেশী সময় ধরে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি গুণে নাস্তানাবুদ হয়ে শ্রীলংকা সরকারের অনুরোধে ভারতীয় সর্বশেষ সৈন্যটি ফিরে যায় ১৯৯০ সালে। এইখানে পাঠকদেরকে যে বিষয়টি না জানালেই নয়, তাহলো প্রারম্ভে এলটিটিই গঠনে তরুন প্রভাকরনকে ভারত কর্তৃক সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ সবধরনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতার বিষয়টি। ৭০’র দশকে ইন্দিরা সরকার ভারতীয় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’কেও এর সাথে সম্পৃক্ত করে। এমনকি প্রভাকরনের একসময় অফিসও ছিল তামিলনাড়ুতে। ইন্দিরা গান্ধী কংগ্রেসের থলেতে ভারতীয় তামিলদের ভোট পাকাপোক্ত করতেই শ্রীলংকাবিরোধী আন্দোলনকে উৎসাহিত করেছেন যার শেষ হলো বহু বন্ধুর ও রক্তাক্ত পথ পাড়ি দিয়ে।

ভারতীয় শান্তি রক্ষী বাহিনী স্বদেশে ফিরে গেলেও প্রতিহিংসাপরায়ন টাইগারদের রাগ এতটুকুও কমেনি। সুযোগ খুঁজতে থাকে বদলা নেয়ার। সুইসাইড স্কোয়াড দলের ব্ল্যাক টাইগাররা স্বল্প সময়ের ব্যবধানে শান্তি চুক্তি সম্পাদনকারী দুই দেশের দুই রাষ্ট্রপ্রধানকেই নির্মমভাবে শেষ করে দেয়। রাজীব গান্ধীকে হত্যা করে ১৯৯১ সালে আর শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট রানাসিংহ প্রেমাদাসাকে ১৯৯৩ সালে।
তিন দশকের এই লড়াইয়ে যুদ্ধ-বিরতির হরেক রকমের প্রস্তাবনা এসেছে। স্বাধীন রাষ্ট্র থেকে সরে এসে স্বায়ত্বশাসন, স্পেশ্যাল স্ট্যাটাস কত কিছু! অন্ততঃ চারবার শান্তিচুক্তি ভেঙ্গে যায়। সর্বশেষটি ভন্ডুল হয় ২০০৬ সালে। তখন থেকেই শ্রীলংকান সেনাবাহিনী সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়ে এলটিটিইকে কোনঠাসা করে ফেলে। এরই ধারাবাহিকতায় এক সময় যারা দেশের এক তৃতীয়াংশ বা কমপক্ষে ১৫ হাজার বর্গকি.মি. এলাকা নিয়ন্ত্রণ করত সেই দুর্ধর্ষ ও অজেয় টাইগারদের তাড়িয়ে সেনারা মোল্লাইথিভু জেলার মাত্র ১.৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের জংগলের মধ্যে আটকিয়ে ফেলে করে। কট্টর তামিলবিরোধী প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাক্স তখন থেকেই বিজয়ের বার্তা গুণতে থাকেন। যাহোক, নৃশংস এই যুদ্ধে দুই পক্ষের প্রাণহানী হয়েছে প্রায় পৌণে এক লাখ বনি আদমের, বাস্তুচ্যুত ও ডায়াসপোড়া হয়েছে লক্ষ লক্ষ তামিল। উল্লেখ্য, শ্রীলংকার মোট জনসংখ্যা প্রায় তিন কোটি। এর মধ্যে ৭৪% বৌদ্ধ ধর্মানুসারী সিংহলী, মাত্র ১৮% তামিল হিন্দু, বাকী ৮% মুসলিম ও অন্যান্য।

শুরু থেকেই তামিল মুসলিম সম্প্রদায় প্রভাকরণের সাথে থাকলেও ক্রমান্বয়ে তিনি এলটিটিকে শুধুমাত্র হিন্দুদের বাহিনীতে পরিণত করেন। আশির দশক থেকে তিনি এলটিটিই নিয়ন্ত্রিত উত্তরাঞ্চল থেকে মুসলমানদেরকে সম্পূর্ণরুপে বিতাড়িত করার বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। সবচেয়ে বড় মুসলিমবিরোধী ক্যাম্পেইনটি শুরু হয় ১৯৯০ সালে। এ বছরে এক গ্রীষ্মেই উত্তরাঞ্চল থেকে ৩৭০ জন এবং পূর্বাঞ্চল থেকে ১১ জন মুসলিমকে হত্যা করে টাইগাররা। প্রচুর মাদ্রাসা-মসজিদ তছনছ করা হয়। কয়েক ডজন হাজীকে সৌদী থেকে ফেরৎকালে হত্যা করা হয়। গণহত্যার বাইরেও ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনেক নামকরা ও নামহীন মুসলমানদের অকাল সমাধি হয়। ১৯৮৯ সালের ২৮ অক্টোবর তারিখের মধ্যে ম্যানার অঞ্চলের মুসলমানদেরকে ভিটে-মাটি চিরতরে ছাড়ার নোটিশটি এভাবে দেয়া হয়, ‘ All Muslims living in Manner island should leave by 28 October. Before leaving, they must seek permission and clearance at the LTTE Office. The LTTE will decide their exit route’ (অর্থাৎ ম্যানার আইল্যান্ডের সব মুসলমানদেরকে ২৮ অক্টোবরের মধ্যে আইল্যান্ড ছাড়তে হবে এবং ছাড়ার পূর্বে অবশ্যই এলটিটিই অফিস থেকে অনুমতি ও ছাড়পত্র সাথে নিতে হবে। আর টাইগাররাই সিদ্ধান্ত নিবে কোন পথ দিয়ে তারা বের হয়ে যাবে।)

এলটিটিই’র শক্ত ও সুসংগঠিত মিলিটারী কাঠামো ছিল। আত্মঘাতী স্কোয়াড ‘ব্ল্যাক টাইগার’, সুসজ্জিত মেরিন বাহিনী ‘সি টাইগার’, এমন কি মডার্ণ একটি এয়ার ফোর্স ‘এয়ার টাইগার’ও ছিল (যা কিনা পৃথিবীর ইতিহাসে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত কোন গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে প্রথম বিমানবাহিনী), ইন্টেলিজেন্ট উইং, পলিটিক্যাল উইং সবই তাদের ছিল। উল্লেখ্য, এই সংগঠনটিকে আমেরিকা, কানাডা, বৃটেনসহ ৩২টি দেশ সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছিল।

মিলিটারী শক্তি হিসেবে প্রধাণত এলটিটিইর ব্যাপক পরিচিতি থাকলেও পর্যায়ক্রমে এরা নর্থ আইল্যান্ডের গোটা এলাকায় একটি ক্রিয়াশীল স্বঘোষিত বেসামরিক ‘গভর্ণমেন্ট’ সফলভাবে প্রতিষ্ঠা করতেও সক্ষম হয়। এই মিনি সরকারের অধীনে বিচারবিভাগ (ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট, হাইকোর্ট, সুপ্রীম কোর্ট, এমনকি আপিল কোর্ট) ছিল। ধর্ষণ, খুন-খারাবি, চাঁদাবাজি ইত্যাদি অপরাধসমূহ বিচারের জন্য দুটো হাইকোর্ট আর তামিল ইলমদের বিচারের দায়িত্বে ছিল সুপ্রীম কোর্ট। বিচার বিভাগ ল’বুকের আপডেট ভার্সনও বের করত। টাইগাররা দাবী করত তাদের বিচারালয় ও নিজস্ব পুলিশবাহিনী সক্রিয় থাকায় জাফনাঞ্চলে তুলনামূলকভাবে অপরাধপ্রবণতা অনেকাংশে কম ছিল। যদিও সমালোচকরা বলে থাকেন, এই পুলিশবাহিনী স্বেচ্ছাচারী এলটিটিই’র আজ্ঞাবহ থাকায় জনসাধারণ সারাক্ষণ ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকত।

সামাজিক নিরাপত্তা ও মানবিক দিকসমূহ দেখভালের জন্য টাইগাররা সোশ্যাল ওয়েলফার চালু করেছিল। ফান্ডে টাকা আসত জনগণের কাছ থেকে ট্যাক্স ও বিদেশ থেকে সহানুভূতিশীল সংগঠনসমূহ থেকে। এই অর্থ তামিলদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করত। অভিন্ন শিক্ষা পদ্ধতির জন্য সুন্দর একটা স্কুলিং সিস্টেমও তারা প্রণয়ন করেছিল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় স্বীকৃতি না দিলেও এলটিটিই নিজেদের জন্য বানিয়েছিল একটা হিউম্যান রাইট্‌স কমিশন।

‘ভয়েস অব টাইগারস্‌’ নামে একটি রেডিও স্টেশন এবং ‘ন্যাশনাল তামিল ইলম টেলিভিশন’ নামে একটী টিভি স্টেশন টাইগার নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে সম্প্রচারিত হত। ‘ব্যাংক অব তামিল ইলম’ নামে উচ্চসূদের একটি ব্যাংক তাদের ছিল। প্রশাসনিক রাজধানীর নাম ছিল কিলিনোচছি। ২০০৪ সালের প্রলয়ংকরী সুনামীর তান্ডবে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের জন্য এলটিটিই ‘সুনামি টাস্ক ফোর্স’ গঠণ করে সাধারণ মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে বিশ্বসম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়।
তাদের মহিলা শাখাটিও ছিল খুব শক্তিশালী। চরম পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিগৃহীত, নির্যাতিত ও অবহেলিত মহিলাদেরকে টাইগারদের ‘নারী-স্বাধিকার’ অবস্থান বেশ আকর্ষণ করেছিল। জীবনের ঝুঁকি উপেক্ষা করে নিম্নবর্ণ ছাড়াও অপ্রত্যাশিতভাবে অগণতি শিক্ষিত ও উচ্চ শ্রেণীর মেয়েরাও এতে যোগ দেয়। আনুমানিক চার হাজার মহিলা ক্যাডার ছিল। এদের মধ্যে একশোজন আত্মঘাতী ‘ব্ল্যাক মহিলা টাইগার’ সদস্য প্রাণ হারায়। ‘ফ্রিডম বার্ড’ নামে তাদের প্রথম অপারেশনটি হয় ১৯৮৭ সালে এবং প্রথম আত্মঘাতী মহিলা যোদ্ধার নাম ‘মালতি’। যুদ্ধ-বিগ্রহ ছাড়া সাংস্কৃতিক ও প্রকাশনা অংগনেও মহিলা টাইগারদের প্রবল পদচারণা ছিল। মোদ্দাকথা, তারা তাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে চমকপ্রদ ও সৃষ্টিশীল নানান কর্মকান্ডের মাধ্যমে শ্রীলংকান তামিল ছাড়াও সারা বিশ্বের তামিলদের একচ্ছত্র সমর্থন লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। এমন একটি সুসংগঠিত ও সুসজ্জিত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী গেরিলা গোষ্ঠীর সর্বশেষ পরিণতি অনেককেই হতভাগ করেছে। ধরাছোঁয়ার বাইরে ত্রাস সৃষ্টিকারী,তামিল কমিউনিটির অবিসংবাদিত ও অপ্রতিরোধ্য প্রবাদপুরুষ ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের ক্ষুদ্র একটি প্রাইভেট কার যোগে জংগল থেকে পলায়নরত অবস্থায় সিংহলী সেনাদের হাতে রুগ্ন মেষশাবকের ন্যায় করুণ মৃত্যু হয়েছে। বিশ্ববাসীকে নিশ্চিত করতে মৃত্যুর পরে টাইগার প্রধাণের মরা-মুখ এদিক ওদিক ঘুরিয়ে তামিলভূমি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন-সাধ চিরতরে মিটানোর দৃশ্য সরকারী টিভি চ্যানেলে প্রদর্শিতও হয়েছে যা কেউ আগে ভাবতেই পারেনি। স্বাধীনতার পর থেকে সংখ্যাগুরু সিংহলীরাই দেশ চালাচ্ছে যাদের পূর্ব-ইতিহাসে অন্যান্য গোষ্ঠীর সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগির রেকর্ড খুব বেশী নাই। যুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতিতে পরাজিত ও বিধ্বস্ত তামিল জাতির সাথে তারা কেমন আচরণ করবে তাই-ই এখন দেখার বিষয়।