মন্ত্রীর মূল ধাতু ‘মন্ত্র’ শব্দটি সংস্কৃত থেকে বাংলায় এসে ঢুকে পড়েছে। অর্থ হল বিচক্ষণ মানুষদের কথাবার্তা। পনেরোশ’ খৃষ্টপূর্বাব্দ বেদীয় যুগ থেকে এই শব্দটির চালু রয়েছে বলে বাংলাপিডিয়া লিখেছে। ভক্ত-অনুরক্তদের স্বর্গীয় ভাবাবেগে মত্ত করার জন্য তান্ত্রিক হিন্দু ও বৌদ্ধ উপাসনালয়ে নানা ধরনের ‘মন্ত্র’ উচচারিত হয়। ‘মন্ত্র’ দেয়ার শব্দসমূহ অতি পবিত্র বলে গণ্য, প্রাঞ্জল্য ভাষায় পংক্তিবদ্ধ এবং অতি পাওয়ারফুলও বটে। এতে মন প্রশান্তিতে ভরে যায়, কথার যাদু মালায় সর্বত্রই যেন শান্তির ধারা পরিলক্ষিত হয়। তান্রিক ধর্ম মতে, ‘মন্ত্র’ দিতে গেলে অবশ্যই একজন গুরু লাগে, অর্থাৎ প্রধান মন্ত্রনাদানকারীকে ধরতে হয়। ধর্মাচারকে স্বতঃসিদ্ধ করতে একই মন্ত্রসমূহ সুন্দর, সাবলীল ভাষায় বারবার বলা চাই। যদিও চতুর্থ শতাব্দীর বেদিক পূরোহিত কাতসা এবং বৌদ্ধ দার্শনিকপান্ডব বাসুবন্ধু বলেছেন, ‘মন্ত্র ফন্ত্র হলো একদম বোগাস। ওসবে কোন কাজ হয়না।’
কাজ হোক বা না হোক ‘মন্ত্র’ শব্দের সাথে স্বর্গ ও আধ্যাত্মিকতার ভাব আছে বলে পশ্চিমেও পাদ্রীদেরকে ‘মিনিস্টার’ নামে ডাকা হয়। যেমন, অমুক হলেন ‘মিনিস্টার অব চার্চ হলিক্রস’ অর্থাৎ তিনি হলেন হলিক্রস চার্চের পাদ্রী ।
পানি-পড়া, মন্ত্র-পড়া, ওঝা বা গনকদের কাজ-কর্ম্মের প্রভাব খুব বেশী মানুষদের উপর পড়ে না। এক ব্যক্তি থেকে বড়জোর একটি পরিবার। কিন্তু দেশ চালানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ বা মন্ত্রী-মিনিস্টাররা বোগাস কথা বললে পুরো জাতি প্রভাবিত হয়, প্রতারিত হয়। এমনকি বিভ্রান্তিতে পতিত হওয়ার রেকর্ডও আছে। যেমন, বুশ তার দেশের গোয়েন্দা প্রধানের দেওয়া মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে ইরাক আক্রমণ করেছিলেন।
সারা দুনিয়ার শাসককূলই কম-বেশী এই মিথ্যা কথা বলার কাজটি সচেতনভাবেই করে থাকেন। অন্যভাবে বললে তারা ‘অধিক মিথ্যা’ কিংবা ‘কম সত্য’ কথা বলেন। ডঃ আসকার ইবন শাইখ ১৯ মে মৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগে এনটিভি’র একটি টকশো’ তে উপস্থিত হয়েছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল বর্তমানে কোন্ জিনিস তাঁকে সবচেয়ে ব্যথিত করে। তিনি এক বিন্দু চিন্তা না করে বলেছিলেন, ‘মিথ্যা ভাষণ। সর্বত্রই এখন মিথ্যা। উপর থেকে নীচ পর্যন্ত সবাই মিথ্যা কথা অবলীলায় বলে যায়’।
বাংলাদেশে এর চর্চা উপরদিক থেকে ইদানিং মারাত্মক আকারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ডিজিটাল জেনারেশন ধরে নিয়েছিল জড়াগ্রস্থ পুরোনো ব্যর্থ দিনগুলোকে পায়ে মাড়িয়ে নতুনরা দেশের দিনসব একদম বদল করেই ছাড়বে। কিন্তু বিধি বাম! লংকায় গেলে নাকি সবাই রাবণ হয়! আমাদের রাবনেরা এমন ভাবে মাথা ঝাকিয়ে, গা দুলিয়ে মিথ্যা কথা বলেন, ভাবেন হনুমানেরা বুঝি কিচ্ছু বোঝেনা! কত রাবনের প্রস্থান যে হনুমানদের ইতিহাসে ভরা সেসব নতুন করে বর্তমান রাবনদের বোঝাবে কে?
ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’ বাংলাদেশের সাথে অনেক দেশকেই কিছুটা হলেও ‘আউলা’ করে দিয়ে গেছে। স্বাধীনতার অন্যতম এক মহানায়কের গর্বিত সন্তান ও চৌকষ একজন মন্ত্রী যখন চারদিন ‘সর্দি’ বা ‘হাইবারনেশন’ শেষ করে স্বপ্রণোদিত হয়ে মিডিয়াতে বললেন, ‘কিসের পদত্যাগ? আমরা দিন বদলের জন্য কাজ করছি। পরিবর্তন আনতে চাইলে নিজেদের পরিবর্তিত করতে হবে। ত্যাগের মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে। কাজ করতে গেলে বাধা তো আসবেই সেগুলো ভেঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে (আমারদেশ, জুন৪, ২০০৯),’; ঠিক তখনি কানাডার পার্লামেন্টে তুমুল হট্টগোল বেধে গেল। হাউজ অব কমন্সে কানাডার ন্যাচারাল রিসোর্স মিনিস্টার লিসা রেইটের পদত্যাগের দাবী করল সবগুলো বিরোধী দল মিলে। লিসার স্বহস্তে লেখা ‘সিক্রেট’ সরকারী ডকুমেন্ট সিটিভি’র অটোয়া নিউজরুমে পড়েছিল। ৩ জুন লিসা হাউসে বিরোধী পার্লামেন্টেরিয়ানদের দাবীর মুখে বললেন, ‘অবশ্যই সঠিক পদ্ধতি না মানায় এই কান্ডটি ঘটেছে। পদত্যাগপত্র আমি আগেই জমা দিয়েছিলাম, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তা গ্রহন করেননি।’ প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার বিরোধী দলের তুমুল ‘হো’,‘হো’ ধবনির মধ্যে বললেন, ‘এটা লিসার ভুল নয়। তিনি ওই সময় সরকারী কাজেই অন্যত্র ছিলেন। তাঁর একজন স্টাফের অসতর্কতায় এমনটি হয়েছে। এর জন্য লিসাকে দায়ী করা সমীচিন নয়।’ এরপর আবারো মেডিক্যাল আইসোটোপ নিয়ে সহকারীর সাথে লিসার অসংলগ্ন কথাবার্তার টেপ জনসম্মুখে প্রকাশ হয়ে পড়ায় হারপার প্রশাসনও লজ্জা পেয়েছেন। লিসা সজল নয়নে দুঃখ প্রকাশ করেছেন পার্লামেন্টে সবার সামনে। ইতোমধ্যে রিসোর্স মিনিস্টার অফিসের কমিউনিকেশন বিভাগের ডিরেক্টর জ্যাসমীন ম্যাকডোনেল সব দায়-দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করে পদত্যাগের ঘোষনা দিয়ে ইস্যুটি থেকে নিজেকে সযত্নে প্রত্যাহার করে নিলেন।
আর ওদিকে ব্রিটেনের ইতিহাসে প্রথমবারের মত স্পীকারের পদত্যাগের পর সরকারে যেন শনির দশা লেগেই আছে। এক সপ্তাহের মধ্যেই চারজন ফুল মন্ত্রী এবং দু’জন জুনিয়র মন্ত্রী ‘ব্যক্তিগত’ কারন দেখিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। ওয়ার্ক এন্ড পেনশন বিষয়ক মন্ত্রী জেমস পার্নেল পদত্যাগপত্রটি পাঠানোর সময় সাহস করে প্রধানমন্ত্রী ব্রাউনকেও পদত্যাগের আহ্বান জানিয়ে সাথে একটি চিঠি জুড়ে দিয়েছেন। ব্রাউনের ‘শ্যাম না কূল রাখি’ অবস্থা! চিঠিতে পার্নেল লেখেন, ‘আমি মনে করি আপনার প্রধানমন্ত্রীর চেয়ার ধরে রাখা মানেই বিরোধী দলকে আগামী নির্বাচনে জয়লাভের সুযোগ করে দেয়া। ........ আমি আপনাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি, আপনি প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করুন এই যেমন আমি সরকার থেকে পদত্যাগ করছি।’ প্রধানমন্ত্রী এসব কথাকে উড়িয়ে দিয়েছেন। তাইতো দিবেন, শাসনে থাকলে সবাই এমন পরিচিত প্রতিক্রিয়াই প্রথমে দেখান।
যাহোক, সাধারন মানুষদের মত মন্ত্রীরাও বিপদে পড়ে গেলে মিথ্যা কথা বলেন। শুধু তাই নয়, পদ থেকে ইস্তফা দেয়ার সময়ও শেষবারের মত ‘ব্যক্তিগত’, ‘পারিবারিক’, ‘স্ত্রী-সন্তানকে সময়দান’, ‘সর্দিজ্বর’ ইত্যাদি জাতীয় কথাবার্তা বলে নিশ্চিত প্রস্থান চান। কৌশলজনক কথা বলে এড়িয়ে যাওয়া আর ডাহা বোকা মার্কা মিথ্যা কথা বলা এক নয়। ‘রাষ্ট্রের প্রয়োজনে’ এসব মিথ্যা ও বাড়তি কথা বলার পরিণতি অনেক সময়ই যে মারাত্মক তা এক-এগারো বাংলাদেশে খানিকটা হলেও বুঝিয়ে দিয়েছে। ভেবেছিলাম, ‘লুকিং ফর শত্রুজ’ মার্কা মন্ত্রীদের কবল থেকে দিন বদলের মন্ত্রীসভা রক্ষা পাবে। কিন্তু এ দেখছি বাঘের আক্রমন থেকে বাঁচতে গিয়ে সিংহের থাবায় পড়ে জাতি এখন ‘শকিং ফর দিন বদলের মন্ত্রীজ’!
‘মন্ত্রী’ শব্দটির সাথে পূত-পবিত্রের অমীয় ধর্মীয় গন্ধযুক্ত থাকলেও এখন তাতে মারাত্মক পচন ধরেছে। মিডিয়াতে এমনভাবে ইনারা মিথ্যা কথা বলেন যেন জনগন কিচ্ছু বোঝেনা! কিন্তু জনগন যে শুধু বোঝেন তাই ই নয়, মন্ত্রীরা মগজে কি চিন্তা লালন করেন সেটিও যে বলে দিতে পারেন, তা উনারা ঠাহর করতে পারেন না। সকল সরকারের দুই একজন ছাড়া সব মন্ত্রীই উচ্চশিক্ষিত হন। বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা প্রাপ্ত হন, আবার লেখাপড়া শেষ করে বিদেশীনিকে নিয়ে ঘর করছেন এমনজনকেও ধরে এনে মন্ত্রী বানানোর রেকর্ড আছে। কিন্তু বাংলাদেশের ভাইরাস এতই শক্তিশালী, বাইরের কোন ভাল অভ্যাসই এখানে কাজ করেনা। জিয়াতে নামলেই পূর্বের বদ অভ্যাসসমূহ মূহুর্তেই শরীরে এসে ভর করে। শুরু হয়ে যায় ঠিক পূর্বের স্থানে রেখে যাওয়া নোংরা বক্ররেখা থেকেই নতুন যাত্রা!
পাঠক, এবার আসুন আমাদের ‘চমক মন্ত্রীসভার’ চমকানো কথাসমুদ্র থেকে প্রতিদিনকার খন্ডিত কিছু কথা তুলে আনি।
গুরু মন্ত্রী সংসদে বললেন, ‘আগের আমলে অত হাজার কোটি টাকা শুধু বিদ্যুতের খাম্বা বাবদই লাপাত্তা হয়ে গেছে।’ পূর্ব্বতন মন্ত্রী বলেন, ‘তত কোটি টাকা তো পুরো বিদ্যুত মন্ত্রণালয়ের বাজেটেই ছিল না।’ আরেকজন মন্ত্রী সবদিক থেকেই এগিয়ে আছেন। ব্যবসায়ীদের বার্ষিক মিটিং-এ গিয়ে দেশে ব্যবসা-বানিজ্য ও কর্মবৃদ্ধির কথা বললেই ভাল শোনায়। তা না বলে বলেন, ‘জঙ্গি ও স্বাধীনতাবিরোধীরাই সেনা অফিসারদের মেরেছে (ইত্তেফাক, মার্চ ৭)। তাদের ইন্টারন্যাশনাল কানেকশন খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’ সরকারী তদন্ত কমিটি বল্ল, ‘না ওরা তো মারেনি (মার্চ২১, আমাদের সময়)।’ সাংবাদিকরা মন্ত্রীকে ধরে জিজ্ঞেস করল, দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হয়ে আপনি এ কথা বললেন কেন? মন্ত্রী বললেন, ‘আমার মনে হয়েছে তাই বলেছি (প্রথম আলো, আমারদেশ ২৪ মার্চ)।’তদন্ত কমিটির পুরো প্রতিবেদনটি জনসমক্ষে প্রকাশ না করার কারণ ব্যাখ্যা করে মন্ত্রী বললেন, ‘প্রতিটি দেশেই তদন্ত প্রতিবেদনে তিনটি বিষয় থাকে। এগুলো হচ্ছে ‘সিক্রেট (গোপনীয়), টপ সিক্রেট (অতি গোপনীয়) এবং ওপেন (প্রকাশযোগ্য)। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই গোপন জিনিস প্রকাশ করা হয় না। এ ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে। আগামীতে পুরো তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করার সম্ভাবনা নেই (নয়াদিগন্ত, মে২৯)।’ আরেক বড় মন্ত্রী মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের একই বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে বললেন, ‘যা প্রকাশ হয়েছে তাই ই পূর্নাঙ্গ। পূর্নাংগ প্রতিবেদনই জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়েছে (নয়াদিগন্ত, মে ২৯)।’
কুয়ালামপুর ৫৫ হাজার বাংলাদেশী ভিসা বাতিলের ঘটনায় মন্ত্রী বললেন, ‘এতে বংগবন্ধুর খুনী ও যুদ্ধাপরাধীদের হাত থাকতে পারে (আমারদেশ, মার্চ১৮)।’ ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র মহসিন শেখ ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাকে ক্রসফায়ারে হত্যা করার খবর সব পত্রিকা প্রকাশ করে স্বজনদের বরাত দিয়ে লিখল, ‘তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কোনো অভিযোগ নেই। কোনো থানায় একটি মামলা বা ডিও নেই। কেউ কখনো তাদের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের কাছেও অভিযোগ করেননি।সহপাঠী ও বন্ধুবান্ধবদের কাছেও তারা ছিল খুবই প্রিয়। (আমারদেশ, মে৩০)।’ দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী বললেন, ‘আমরা জনগণের সরকার। জনগণের সেবা করার জন্য ক্ষমতা নিয়েছি। প্রতিটি বিষয়ে আমরা সজাগ রয়েছি। আমরা সব সময় বিচারবহির্ভুত হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে। এ সরকারের আমলে বিচারবহির্ভুত হত্যার কোন ঘটনা ঘটেনি (যুগান্তর, আমারদেশ, মে৩১)।’ ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল ও কৃমিনাশক ট্যাবলেট খেয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে দেড় হাজারের বেশি শিশু অসুস্থ হয়ে পড়ার খবর প্রতিটি পেপার ও চ্যানেলের মাধ্যমে সারা দেশে খবর ছড়িয়ে গেল (যুগান্তর, জুন ৮; মানবজমিন, জুন ৯)। মন্ত্রী মহোদয় বিশ্বস্বাস্থ্যের দেয়া ঔষধগুলো রি-চেক, সঠিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয়েছে কিনা জানার প্রয়োজন বোধ না করে বললেন, ‘এসবই অপপ্রচার, যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, যারা শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে ২১ আগস্ট বোমা হামলা চালিয়েছে, যারা দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়, তারাই এ কাজ করছে (আমারদেশ, নয়াদিগন্ত, জুন৯)।’ সৌদী সফর থেকে ফিরে এসে আগের রেকর্ড না চেক করেই মন্ত্রী উক্তি, ‘বিগত সাত বছরে সৌদির বাদশাহ্র সাথে বাংলাদেশের কোনো প্রধানমন্ত্রীর এটাই প্রথম বৈঠক (জুন ৮, নয়াদিগন্ত)।’ মন্ত্রী বাংলাদেশ ও ভারতের মণিপুরের পানি বিশেজ্ঞদের অবাক করে দিয়ে পিনাকীয় সুরে বললেন, ‘টিপাইমুখে বাধ দিয়ে ভারত পানি বিদ্যুত তৈরী করলে বাংলাদেশের কোন ক্ষতি হবে না (আমাদের সময়, ২০ মে),’ এবং ‘খুশী হয়ে ভারত যতটুকু পানি তাই ই আমাদের লাভ (নয়াদিগন্ত ৮ জুন)।’
এসব আমাদের মন্ত্রীদের কথা, এরকম হাজারো উদ্ধৃতি দেয়া যায়। পাঠকদের ধৈর্য্যচুতি ঘটবে। আর হ্যাঁ, এসব উক্তির জন্য তো বিরোধীদলকেও দায়ী করা যাবেনা।
এমন মন্ত্রীদের দিয়েই আমরা ডিজিটাল বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখব, ভিশন ২০২১ বাস্তবায়নে এগিয়ে যাব, মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে শিখব। আশা করতে পারিনা?
সুন্দর করে কথা বলা একটা আর্ট। ‘সত্য কথা বলা’ কিংবা ‘কথা-বার্তার চেয়ে কাজ বেশী করা’ মন্ত্রীদের শিখতে হবে। সাংবাদিকদের মাইক দেখলেই দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হওয়া যাবে না। উন্নতদেশে মন্ত্রীরা মিডিয়া থেকে পালিয়ে বেড়ান, আর আমাদের দেশে মন্ত্রীরা অফিস থেকে বেড়িয়েই আট-দশটি মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে যান।
পাচঁ মাস খুব বেশীদিন নয়, এতে দিন বদল হয় না। তাই বলছিলাম, বাকী সাড়ে চার বছরে আমাদের মন্ত্রী-মহোদয়বর্গ ‘সত্য ও কঠিন কথা’ সোজা করে বলা শিখে যাবেন। আগের মন্ত্রীরা দেশটাকে বাজে অবস্থায় নিয়ে গেলেও আশা করবো দিন বদলের ‘ফ্রেশ’ মন্ত্রীরা এবার তা আর করবেন না। আরেকটা কথা না বললেই নয়, ইন্দিরা গান্ধীকে ভারতীয় সৈন্য ফেরত নেবার ‘কঠিন সত্য কথাটি’ কিন্তু সহজভাবে বলার রেকর্ড বাংলাদেশের রয়েছে। বাংলাদেশ কোন হেলাফেলাদের দেশ নয়। গর্ব করার মত অনেক কিছুই আমাদের রয়েছে। নোংরা ও অদূরদর্শী রাজনীতিবিদরা দেশটাকে এগিয়ে নিতে বাধা সৃষ্টি করলেও এদেশের মেধাবীরা বিশ্বে সৃজনশীল ইতিহাস সৃষ্টি করতে সাহায্য করছে। গ্লোবাল ভিলেজের যুগে মহারথীদের ভয়ে ভীত হবার কিছু নেই, মানে ইন্ডিয়ার নামটা আসলেই জিহবাটা যেন আড়ষ্ট না হয়ে যায়। জর্জিয়াতে রাশিয়া পারেনি, একক পরাশক্তি আমেরিকার প্রতিবেশী হয়ে ছোট্ট রাষ্ট্র কিউবা বুক ফুলিয়ে টিকে আছে, মহাশক্তিধর বুশ হা হয়ে ছিলেন যখন ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট মুখের উপর তাকে ‘শয়তান’ বলছিলেন। এসবের জন্য ছোট রাষ্ট্রদের যুদ্ধে যেতে হয়নি। আমরা অতি বিপ্লবী হতে চাইনা, দরকারও নেই। শুধু চাই আমাদের সোজা-সাপটা সত্য কথাটা মন্ত্রীরা জোরের সাথে বলুক, বিশ্ববাসী জানুক। মনে রাখতে হবে, ‘শয়তান’ যত বড় শক্তিশালীই হোক না কেন তার ষড়যন্ত্র বড়ই দূর্বল (আল-কোরআনঃ ৪:৭৬)। বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীও কিন্তু বারে বারে এর প্রমাণ দেখিয়েছে।
অস্টম শতাব্দীর জার্মান দার্শনিক কান্ট বলেছিলেন, ‘ফিয়াত জাস্টিফিয়া, পেরিট মুন্ডুস (ইনসাফ নিশ্চিত কর, যদিও পৃথিবী একদিন ধবংস হয়ে যাবে)।’ কথাটাকে ঘুরিয়ে তিনি অন্যভাবে এরকমও বলেছেন, ‘ন্যায়-বিচারকে সমুন্নত রাখো এমনকি পৃথিবীর সব ‘বান্দর’দেরকে এর মাধ্যমে শাস্তি দিয়ে হলেও।’