Thursday, September 4, 2008

মানুষ খুঁজে পাওয়া গেল ব্রাজিলের জংগলে










একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক মানুষেরা বিজ্ঞানের এমন শীর্ষে অবস্থান করছে যে আজ তারা মঙ্গলগ্রহে প্রাণের সন্ধানে ব্যস্ত। মার্কিন মহাকাশ প্রতিষ্ঠান ‘নাসা (NASA)’-র ৪২২ মিলিয়ন ডলার মিশনের একটি নভোযান ‘ফিনিক্স’ গত ২৫ মে মঙ্গলগ্রহের ভূ-পৃষ্ঠে অবতরন করে। ফিনিক্স সেখানে চার মাস এক সপ্তাহ চলাফেরা করে পৃথিবীতে ক্ষণে ক্ষণে রিপোর্ট পাঠাবে। তার কাজ হল প্রাণের অস্তিত্বের অনুসন্ধান করা। ধারনা করা হয়, মঙ্গলের মাটির কয়েক ইঞ্চি নীচে রয়েছে বরফের স্তর। ফিনিক্সের দায়িত্ব হল মাটিতে কতটুকু পানি বা কোন জীবানু লুকিয়ে রয়েছে কিনা তার অনুসন্ধান করা। এই নভো খেয়া যানটি এ পর্যন্ত কয়েকটি ছবি পৃথিবীতে পাঠিয়েছে । তার মধ্যে একটি ছবিতে এক ফুট তিন ইঞ্চি গভীর সাদা রঙের কোন বস্তুর দেখা পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীরা ধারনা করছেন এটি হয় বরফ নতুবা লবন। বরফ হলে এর শোধিত হওয়ার দাবী রাখে অথবা তরলীকরন ছাড়াই এটি কঠিন থেকে বায়বীয়তে রূপান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনাও আছে। কারন হল, গ্রহটির শীতল তাপমাত্রা (দিনের বেলায় ১৫ ডিগ্রী ও রাতে মাইনাস ১৪০ ডিগ্রী সেলসিলয়াস) এবং বায়ুমন্ডলের চাপও কম । আর যদি লবন হয়, তবুও তাৎপর্যপূর্ন। কারন, পানি বাস্পীভূত হয়ে ভূ-পৃষ্ঠে লবন তৈরির পদ্ধতিটাই হল সাধারন। বিজ্ঞানীরা পানির অস্তিত্ব প্রমানে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। সর্বশেষ ছবিতে তারা নিশ্চিত যে পানি আছেই। আরো প্রমানের জন্য তাঁরা উক্ত মাটির খন্ডটিকে পৃথিবী থেকেই ১৮০০ ডিগ্রীতে উন্নীত করার পরিকল্পনাও করছেন।

পৃথিবীর থেকে ন্যুনতম ৫০ মিলিয়ন মাইল দূরের গ্রহে প্রাণ আবিস্কারের নেশায় মানুষের যদি এই অবস্থা হয়, তখন একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের আর সব অগ্রগতি সম্মন্ধে কিইবা বলার থাকে? অথচ এই পৃথিবীর কোন জংগলেই লুকিয়ে রয়েছে হরেক রকমের মানবগোষ্ঠী যাদের সম্মন্ধে আধুনিক মানুষদের কোন ধারনাই নাই। এটা কি বিশ্বাসযোগ্য যে, সভ্য দুনিয়ার সাথে কোন সংযোগই নাই, গহীন বনে বাস করা এরকম গোত্রের মানুষ এখনো প্রচুর?

ব্রাজিল ও পেরুর সীমান্তবর্তী প্রদেশ ‘আকরি (Acre)’-র বনাঞ্চল আমাজনের দক্ষিনাঞ্চলের গহীন অরণ্যে এই ‘সংস্পর্শবিহীন গোত্র (Uncontacted tribe)’-এর সন্ধান পাওয়া গেছে। নৃতাত্ত্বিকদের ভাষায় ‘আনকন্টাক্টেড ট্রাইব’ তাদেরকে বলা হয়, যাদের সম্মন্ধে বাইরের মানুষেরা কমবেশী জেনে গিয়েছে কিন্তু তাদেরকে সভ্য মানূষদের সংস্পর্শে আনা আজ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। এ বছরের এপ্রিল ২৮ থেকে মে ২ পর্যন্ত ছোট ঊড়োজাহাজ নিয়ে টানা বিশ ঘন্টা ধরে ক্যামেরা নিয়ে এই নতুন গোত্রের মানুষদের সনাক্ত করা হয়। ৩০ মে বিবিসি, সিএনএন, ইউটিউবসহ আন্তর্জাতিক সব মাধ্যমে ছবিগুলো প্রকাশিত হয়। আদিবাসীদের নিয়ে ব্রাজিলের সরকারী গবেষনা প্রতিষ্ঠান ‘জাতীয় ইন্ডিয়ান ফাউন্ডেশন (The National Indian Foundation, সংক্ষিপ্ত নাম, ‘ফুনাই Funai’)’ বলেছে, সারা পৃথিবীতে একশোরো বেশী সংস্পর্শবিহীন গোত্রের মানুষজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন জংগলে। এদের মধ্যে শুধু মাত্র পেরু বা ব্রাজিলেই থাকতে পারে অর্ধেকেরো বেশী। ‘সারভাইভাল ইন্টারন্যাশনাল (Survival International)’ নামে অলাভজনক একটি প্রতিষ্ঠান, যারা আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে কথা বলে, তাদের মতে সব গোত্র সমূহই জোর করে তাদের ভূমি থেকে বিতাড়িত, হত্যা ও নানাবিধ রোগ-শোকে আক্রান্ত হওয়াসহ প্রভূত বিপদের সম্মুখীন।

ওইসব গোত্রের মানুষদের নিকট পৌঁছানো যথেষ্ঠ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। একে তো গহীন অরন্য, তারপর রয়েছে আদিবাসী কর্তৃক ‘বহিঃশত্রু অনুপ্রবেশকারীদের’ ঠেকানোর জন্য গাছের বড় বড় গুড়ি রাস্তায় ফেলে প্রতিবন্ধক সৃষ্টি। এর ফলে তাদের সম্মন্ধে জানার শেষ পথও অসম্ভব হয়ে উঠেছে।

সর্বশেষ আবিষ্কৃত নতুন এই গোত্রের মানুষদের চিহ্নিত করার মধ্যদিয়ে ব্রাজিলে এ পর্যন্ত মোট ৬৮ টি আনকন্টাক্টেড ট্রাইবের সন্ধান পাওয়া গেল, যারা কিনা আধুনিক দুনিয়ার মানুষ থেকে সরাসরি বিচ্ছিন্ন। হেলিকপ্টার দিয়ে প্রাপ্ত ছবিগুলোতে দেখা যায়, অচেনা এই গোষ্ঠীটি তীর, বল্লম নিয়ে ক্যামেরা বরাবর তাক করছে। তাদের বাড়িগুলো দেখে মনে হচ্ছে তাল জাতীয় শাখাহীন বৃক্ষের গুল্ম, লতা-পাতা দিয়ে ছাওয়া কুটির। এসব কুটিরকে বলা হয় ‘ম্যালোকাস (malocas)’। কুটিরের বাসিন্দারা বুঝি ভাবছে তাদের এলাকাটি হুমকির সম্মুখীন। তাই প্রতিরক্ষার জন্য তাদের নিত্য ব্যবহার্য হাতিয়ারসমূহ দ্বারা হেলিকপ্টারকে প্রতিহত করতে যুদ্ধ সাজে প্রস্তুত হয়ে আছে।

সারভাইভাল ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপের ডিরেক্টর স্টিফেন কোরী (Stephen Corry) বলেছেন, অনেকেই এই গোষ্ঠীটির অস্তিত্বের ব্যাপারে পূর্বে সন্দিহান ছিল। আজ এইসব ভিডিও ছবির মাধ্যমে পরিষ্কার হল যে আজো পৃথিবীতে অজানা মানুষের উপস্থিতি বিদ্যমান। এদেরকে সভ্য মানুষ বানানোর নামে তাদেরকে জংগল থেকে একেবারে নিয়ে আসারও পক্ষপাতী নন নৃতত্ত্ববিদরা (Anthropologists)। তাঁরা বলছেন, তা হলে হবে ‘স্মৃতিচিহ্ন ধ্বংসের মত অপরাধ’ যাকে বলে ‘মন্যুমেন্টাল ক্রাইম (monumental crime)’।

কেননা, এদেরকে আধুনিক মানুষ বানানোর প্রচেষ্টার পূর্বের ইতিহাস খুব একটা সুখকর নয়। সভ্য মানুষদের সংস্পর্শে এসেই তারা অসুস্থ হয়ে পড়ে। আমাদের খাবার খেতে পারেনা। সিদ্ধ করা খাবারে তাদের জিহবায় গোটা গোটা ফুসকুরি জাতীয় এমন সব অজানা রোগে আক্রান্ত হয় যা কিছুতেই সারানো যায় না। পানি-বসন্ত থেকে শুরু করে সাধারন ঠান্ডা-কাশিতেই তাদের মৃত্যু হয়। শরীর আধুনিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বহন না করায় খুব সহজেই সাধারন অসুখেই প্রানহানি হওয়ায় নৃতাত্ত্বিকেরা তাদেরকে বাহিরে আনার প্রচন্ড বিরোধী।

ফুনাই (Funai)-র তোলা ফটোগুলো থেকে ধারনা করা হয়, গোত্রের প্রায় এক ডজনের মত মানুষ, যাদের শরীরের বেশীরভাগই অনাবৃ,ত, ৬টি কুটিরের সামনে তীর, ধনুক নিয়ে পজিশনরত। লাল রঙ দিয়ে শরীর চিত্রিত করা মানুষদের পুরুষ হিসেবে, আর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা কালো রঙ দ্বারা সারা গা মাখানো জনকে মহিলা হিসেবে মনে হয়।ছবিতে পুরুষদের খুব শক্তিশালো মনে হচ্ছে।

আরো ছবি দেখার জন্য এখানে ক্লিক করুনঃ
এই দল সম্মন্ধে নৃতত্ত্ববিদরা একেবারে জানেন না বললেই চলে। তবে তাদের সন্দেহ গোত্রটির সাথে ‘টানো (Tano)’ এবং ‘আরোয়াক (Aruak)’-এর সংযুক্ততা থাকতে পারে। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়ায় একশোটিরো বেশী এসব সংস্পর্শহীন গোত্র বিভিন্ন অরন্য, সাগরতীরে বিচ্ছিন্নভাবে বাস করছে। অবৈধভাবে বৃক্ষ নিধনের ফলে সম্প্রতি পেরুর সীমান্ত থেকে প্রায় পাঁচশো জন ইন্ডিয়ান (আদিবাসীদেরকে ইন্ডিয়ানও বলা হয়) ব্রাজিলের দিকে গহীন পুরু অরণ্যে স্থানান্তরিত হয়েছে। আধুনিক লোকদের সংস্পর্শে থাকা তার পছন্দ করেনা।

দীর্ঘ ও ভারী বল্লম নিয়ে হৃষ্টপুষ্ট শরীরের মানুষগুলোদের ‘শত্রু’ মোকাবেলার ভংগিকে রীতিমত যোদ্ধাদের দল বলে মনে হয়। জীব-জন্তুদের সাথে বাস করায় তাদের দাঁড়ানোর ভংগিটিও হয়তোবা কোন জন্তুর কাছ থেকে নকল করেছে। তবে বাসস্থানের জন্য ঘর বানানোর সাধারন বুদ্ধি ও কৌশল বুঝি তাদের রয়েছে। নইলে ঘরগুলো ঠিক আমাদের সাধারন মানুষদের ঢালু দুচালের শনের তৈরি ঘরের মতো হত না।

ব্রাজিলে সর্বমোট প্রাপ্ত ৬৮টি সংস্পর্শহীন গোত্রের প্রায় সব ক’টিই পাশ্চাত্যের সভ্যতার ব্যাপারে কমবেশী জ্ঞান থাকার কথা। কারন, রাবার চাষী, বন-চোর ও অন্যান্য গোত্র (যারা বাইরের মানুষের সাথে সম্পর্ক রাখে)-র সাথে বেচাকেনা ইত্যাদিতে তাদের সাক্ষাৎ মেলে।

সারভাইভাল ইন্টারন্যাশনাল অনুমান করেছে, পৃথিবীব্যাপী প্রায় ১০০টি গোত্র রয়েছে যারা সভ্য দুনিয়া থেকে একেবার সংস্পর্শহীন থাকাতেই পছন্দ করে যদিও বাইরের দুনিয়া সম্মন্ধে জ্ঞান তাদের কিছুটা রয়েছে। সত্যি বলতে কি, এসবগুলোর মধ্যে বংগোপসাগরের তীরে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দা ‘সেন্তিনেলিজ (Sentinelese)’ গোত্রই মুলতঃ জানার মধ্যে প্রকৃতপক্ষে একমাত্র ‘সংস্পর্শহীন গোত্র’। কেননা, এরা কোনভাবেই বাইরের সাথে সম্পর্কিত নয়। দক্ষিণ আন্দামানের উত্তর সেন্তিনেলে ৭২ বর্গ কিমি জুড়ে এদের অবস্থান। দ্বীপের নিকটবর্তী মানুষেরা তাদেরকে কদাচিৎ দেখলেও বিস্তারিত জানার সুযোগ নেই। কারন, বাইরের কাউকে দেখলেই এরা ধেয়ে আসে, দখলদার ভেবে তীর ছুঁড়ে তাড়িয়ে দেয়। ২০০১ সালে ভারতের আদমশুমারী অনুযায়ী এদের সংখ্যা বলা হয়েছিল ২১ জন পুরুষ ও ১৮ জন মহিলা। কিন্তু সত্যিকার তথ্য পাওয়া অসম্ভব। গবেষকরা মনে করেন, এই সংখ্যা হবে কমপক্ষে ৪০ থেকে সর্বোচচ ৫০০ জন। ২০০৪ সালে ভারত সাগরের ভূমিকম্প ও সুনামীতে তাদের ভাগ্য জানা না গেলেও তারা যে বেঁচে আছে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই সেন্তিনেলিজদেরকে বলা হয় ‘নেগ্রিটস (negritos)’ যারা হবে দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার মানুষজন থেকে বিচ্ছিন্ন কোন এক জাতি। আবার এদের সাথে সংযুক্তা রয়েছে মালয় দ্বীপপুঞ্জের ‘সেমাং (Semang)’ গোত্রের সাথে। ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জের ‘এইটা (Aeta)’ গোত্র, এমনকি দক্ষিণ আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের সাথেও এদের সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন নৃতাত্ত্বিকেরা।

তুলনামূলকভাবে নেগ্রিটদের খাটো ও কালো চামড়ার শরীর এবং কুকড়ানো চুলসহ এমন সব আরো বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া গেছে, যাদের সাথে আবার আফ্রিকানদের চেহারাও মিলে যায়। তবে এরা কিন্তু সাধারন আন্দামানবাসীদের চেয়ে লম্বা। গড় উচচতা পুরুষদের ৬ ফুট ও মহিলাদের ৫ফুট ৪ ইঞ্চি।

এসব আদিবাসীদের জীবন-রক্ষা ও তাদের জীবনযাত্রার মান নিয়ে বিশ্ববাসীর আরো চিন্তা করা দরকার। নইলে এই মানুষগুলো একদিন বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে কোন গ্রহে প্রানের সন্ধান খোঁজার চেয়ে এই মানুষগুলোর প্রাণ রক্ষাও কম জরুরী নয়।
*লেখাটা ঢাকা থেকে প্রকাশিত মাসিক অন্যদিগন্ত সেপ্টেম্বর ২০০৮ সংখ্যায় এসেছে।

2 comments:

যাযাবর said...

সোনারবাংলা ডট কমে লেখাটা আগেই পড়েছি। এখন ছবিগুলো দেখলাম। লেখাটা একটানে পড়েছি। ছবিগুলো দেখে কেমন যেন অদ্ভূদ একটা ফিলিংস হচ্ছে। ওরা দেখি হেলিকাপ্টারের দিকে তীরও মারছে! ছবির লিংক'র নীচের কমেন্টসগুলো বেশ মজার এবং ভাবার মত।

Shahin Siddiquee said...

অনেক ধন্যবাদ, যাযাবর। আমি যখন জানতে পেরেছিলাম, বেশ অবাক হয়েছিলাম। তারপরে পড়াশোনা করে দেখলাম এরকম আরো অনেক অজানা কাহিনী। বিশ্বাস হয়? এই যুগে কিছু মানুষজনদের এই অবস্থা!